কিশোরীদের চেষ্টায় ত্রিশাল বাল্যবিবাহমুক্ত, ঘোষণা প্রশাসনের

ত্রিশাল উপজেলাকে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোজাম্মেল হক খান। ত্রিশাল, ময়মনসিংহ, ১৬ মে। ছবি: কামরান পারভেজ
ত্রিশাল উপজেলাকে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোজাম্মেল হক খান। ত্রিশাল, ময়মনসিংহ, ১৬ মে। ছবি: কামরান পারভেজ

ছয় মাস আগে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের উদ্যোগ হিসেবে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় স্কুলপড়ুয়া ১০ জন ছাত্রীকে নিয়ে গঠন করা হয় ব্রিগেড। প্রথম দলটি ছিল পরীক্ষামূলক। ওই দল দ্রুত সময়ের মধ্যে আস্থা অর্জন করে। এর ধারাবাহিকতায় ছয় মাসের মধ্যে গড়ে ওঠে এ রকম আরও ১৭টি ব্রিগেড। মোট ১৮টি কিশোরী ব্রিগেডে কাজ করে ১৮৬ জন কিশোরী। তাদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আজ বুধবার ত্রিশাল উপজেলাকে প্রাথমিকভাবে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। চূড়ান্ত ঘোষণার আগে এই উপজেলার বাল্যবিবাহ পরিস্থিতি এক বছর নজরদারিতে রাখবে প্রশাসন।

আজ বুধবার সকাল নয়টায় ত্রিশাল দরিরামপুর নজরুল একাডেমি মাঠে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোজাম্মেল হক খান। উপজেলাকে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আজ থেকে আগামী এক বছর ত্রিশাল উপজেলা আমাদের নজরদারিতে থাকবে। ওই এক বছরে যদি কোনো বাল্যবিবাহ না হয়, তাহলে আমরা ত্রিশাল উপজেলাকে পুরোপুরি বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা করব।’

মোজাম্মেল হক খান কিশোরী ব্রিগেডের পরিকল্পনায় মুগ্ধ হয়ে বলেন, সারা দেশের ৪৯২টি উপজেলায় এ রকম ব্রিগেড গঠন করে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করে সফলতা অর্জন করা সম্ভব।

ত্রিশাল উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা অনুষ্ঠানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল উপজেলাজুড়ে গত ছয় মাস বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করা কিশোরী ব্রিগেডের সদস্যরা। গত ছয় মাসে সাদা অ্যাপ্রোন পরিধান করে সাইকেল চালিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে তারা গ্রামের মানুষকে বাল্যবিবাহের কুফল জানান দিয়েছে। বন্ধ করে দিয়েছে ৬৫টি বাল্যবিবাহ। তাদের কৃতিত্বেই উপজেলাকে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

ত্রিশাল দরিরামপুর নজরুল একাডেমি মাঠে কিশোরী ব্রিগেডের সদস্যরা। ত্রিশাল, ময়মনসিংহ, ১৬ মে। ছবি: কামরান পারভেজ
ত্রিশাল দরিরামপুর নজরুল একাডেমি মাঠে কিশোরী ব্রিগেডের সদস্যরা। ত্রিশাল, ময়মনসিংহ, ১৬ মে। ছবি: কামরান পারভেজ

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কিশোরী ব্রিগেড গঠনের পরিকল্পনাটি করেন ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু জাফর রিপন। আজ তিনি অনুষ্ঠানের শুরুতে বলেন, ত্রিশাল উপজেলায় অনেক বাল্যবিবাহ হতো। খবর পাওয়ার পর পুলিশ পাঠিয়ে তা বন্ধ করা হয়েছে। অনেক সময় উপজেলা সদর থেকে দুর্গম কোনো এলাকায় বাল্যবিবাহের খবর প্রশাসনে এসে পৌঁছাত না। এ থেকে উপলব্ধি হয়, শুধু আইন প্রয়োগ করে, পুলিশ পাঠিয়ে বিয়ের দিনে বিয়ে বন্ধ করে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা যাবে না। প্রতিরোধ করতে হলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রয়োজন। এ চিন্তা থেকেই গত বছরের ৩১ অক্টোবর পরীক্ষামূলকভাবে ধলা উচ্চবিদ্যালয়ের ১০ জন ছাত্রীকে নিয়ে কিশোরী ব্রিগেড গঠন করা হয়। ব্রিগেড সদস্যদের সাইকেল ও অ্যাপ্রোন কিনে দেন স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিরা।

আবু জাফর রিপন জানান, প্রথম দলটি সফল হওয়ায় গত ৬ ফেব্রুয়ারি আরও ১৩টি বিদ্যালয়ে একযোগে ব্রিগেড গঠন করা হয়। বর্তমানে ১৮টি ব্রিগেড বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করছে। কিশোরীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ব্রিগেড খুব দ্রুত উপজেলাজুড়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পেরেছে। কোথাও বাল্যবিবাহের খবর পেলেই তারা ক্ষিপ্রতার সঙ্গে দল বেঁধে যাচ্ছে। অভিভাবককে বুঝিয়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করছে। কোথাও ব্যর্থ হলে তারা উপজেলা প্রশাসনকে জানাচ্ছে। পুলিশ গিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধ করছে। গত ছয় মাসে কিশোরীরা ত্রিশাল ও গফরগাঁও উপজেলায় মোট ৬৫টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছে। পুরো প্রক্রিয়ায় সার্বক্ষণিক পরামর্শ দিয়েছেন বিভাগীয় কমিশনার জি এম সালেহ উদ্দিন ও ময়মনসিংহের বিদায়ী জেলা প্রশাসক মো. খলিলুর রহমান।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেয় প্রথম ব্রিগেডের দলনেতা তৃপ্তি। সে বলে, ‘বাল্যবিবাহ বন্ধ করার কাজ করে আমরা খুব গর্বিত। আমরা নিজেদের পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে দেশের জন্য কাজ করছি।’

অনুষ্ঠানে ময়মনসিংহ বিভাগের কমিশনার জি এম সালেহ উদ্দিনের সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য দেন, পুলিশের ময়মনসিংহ রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) নিবাস চন্দ্র মাঝি, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুলতানা রাজিয়া, ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস, শেরপুরের জেলা প্রশাসক মল্লিক আনোয়ার, ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম ও ত্রিশাল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জয়নাল আবেদিন।