যাত্রীদের কষ্ট, ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ

বাস যাবে সিলেট। সকাল ৮টায় ছাড়ে সায়েদাবাদ থেকে। প্রায় ৮ কিলোমিটার আসতেই সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। কষ্টে–ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েন যাত্রীদের অনেকে। ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের সানারপাড় বাসস্ট্যান্ডে যানজটের কবলে পড়া নিউলাইন বাসের ভেতরের দৃশ্য। গতকাল বেলা দেড়টায়।  ছবি: দিনার মাহমুদ
বাস যাবে সিলেট। সকাল ৮টায় ছাড়ে সায়েদাবাদ থেকে। প্রায় ৮ কিলোমিটার আসতেই সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। কষ্টে–ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েন যাত্রীদের অনেকে। ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের সানারপাড় বাসস্ট্যান্ডে যানজটের কবলে পড়া নিউলাইন বাসের ভেতরের দৃশ্য। গতকাল বেলা দেড়টায়। ছবি: দিনার মাহমুদ
>
  • ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দেশের ‘লাইফ লাইন’ বলে খ্যাত
  • যানজটে রমজানের ভোগ্যপণ্যসহ আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন ব্যাহত
  • যানজটের চার কারণ

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফেনীর অংশে যানজট না কাটতেই কুমিল্লার দাউদকান্দি অংশে তা বিস্তৃত হয়েছে। ফলে আট দিন ধরে স্থবির রয়েছে দেশের ‘লাইফ লাইন’ খ্যাত এই মহাসড়কটি। এতে পবিত্র রমজানের ভোগ্যপণ্য ছাড়াও আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ব্যবসায়ীরা। মহাসড়কে যানজট দীর্ঘায়িত হওয়ায় সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তি হয়েছে সীমাহীন।

ফেনীর ফতেহপুরে রেলক্রসিংয়ে উড়ালসড়ক নির্মাণের কারণে মহাসড়কের উত্তরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, দক্ষিণে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পর্যন্ত ৮৫ কিলোমিটার যানজট বিস্তৃত ছিল। গত সোমবার দুপুরের আগের পাঁচ দিন স্থবির ছিল মহাসড়কটি। সোমবার দুপুরে ফেনীর উভয় দিক যানজটমুক্ত হলেও রোববার রাত আটটা থেকে কুমিল্লার দাউদকান্দি অংশে যানজট শুরু হয়। গতকাল বুধবার রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত এই জট দাউদকান্দির মেঘনা-গোমতী সেতু এলাকা থেকে চান্দিনার মাধাইয়া পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

ফলে মহাসড়কের ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের গন্তব্যে পৌঁছতে পাঁচ ঘণ্টার পরিবর্তে ১৫ থেকে ২৪ ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মাহমুদ ওমর ফারুক মহাসড়কে যানজট দীর্ঘায়িত হওয়ার জন্য ট্রাফিক অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন। বিকল্প সড়ক মসৃণ না রাখায় সড়ক ও জনপথ বিভাগকে দায়ী করেন তিনি।

মাহমুদ ওমর ইমামের ভাষ্য, ফেনীতে রেলক্রসিংয়ের ওপর উড়ালসড়ক নির্মিত হয়েছে। নির্মাণকাজের কারণে গাড়ি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবেই। কিন্তু নির্মাণকাজ শুরুর আগে বিকল্প সড়ক কেন মসৃণ করা হয়নি? বিকল্প সড়কগুলো ঠিক থাকলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দুর্ভোগ কমবে বলে তাঁর মত।

যানজটের চার কারণ
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা মূলত চারটি কারণের কথা বলেছেন। পবিত্র রমজান উপলক্ষে ভোগ্যপণ্যবাহী গাড়ি চলাচল বৃদ্ধি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-নরসিংদীর সড়কে খানাখন্দ বেড়ে যাওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গাড়িও এই মহাসড়ক দিয়ে ঢাকায় চলাচল, মহাসড়কের চার লেনের গাড়ি দুই লেনের মেঘনা, গোমতী ও কাঁচপুর সেতুর ওপর দিয়ে পারাপার, বিকল্প সড়ক ব্যবহারে ফেনী যানজটমুক্ত হলে মহাসড়কে আটকে থাকা হাজার হাজার গাড়ি একসঙ্গে ঢাকামুখী হওয়া এবং সোমবার এই মহাসড়কের সংযোগস্থলে (ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক) একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়া যানজটের প্রধান কারণ। এই যানজট ছুটতে আরও দু-এক দিন লাগতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

কুমিল্লা হাইওয়ে পুলিশ সুপার মো. নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সোমবার হাইওয়ের সিলেট-ঢাকা সড়কের মুখে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে। ওই গাড়ি উদ্ধার করতে কিছু সময় লেগেছে। সেই দুর্ঘটনার প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। কারণ, এই মহাসড়কের মেঘনা-গোমতী সেতুর ওপর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২৭ থেকে ২৮ হাজার গাড়ি পার হয়। রমজানের কারণে পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল বেড়েছে। এক মিনিট গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকলে পেছনে দীর্ঘ জটের সৃষ্টি হয়।

নজরুল ইসলাম আরও বলেন, চার লেনের মহাসড়কে ৭০-৮০ কিলোমিটার গতির গাড়ি দুই লেনের তিনটি বড় সেতুর ওপর ওঠার সময় ৮-১০ কিলোমিটারে নেমে আসে। এতে পেছনে জট দীর্ঘ হচ্ছে। তা ছাড়া ফেনীর জট ছাড়লে হাজার হাজার গাড়ি একসঙ্গে ঢাকামুখী হয়। ফলে মেঘনা ও গোমতী সেতু এলাকার জট কমছে না।

ঢাকামুখী মহাসড়কে নিশ্চল পরিবহন। গতকাল সকাল নয়টায় কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার শহীদনগর এলাকার দৃশ্য।  ছবি: প্রথম আলো
ঢাকামুখী মহাসড়কে নিশ্চল পরিবহন। গতকাল সকাল নয়টায় কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার শহীদনগর এলাকার দৃশ্য। ছবি: প্রথম আলো


ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা
চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দেশের ‘লাইফ লাইন’। সমুদ্রপথের আমদানি ও রপ্তানির সিংহভাগ পণ্য এই মহাসড়ক দিয়ে পরিবহন হয়। কিন্তু একটানা আট-নয় দিন মহাসড়কটি স্থবির। এতে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। রমজানের ভোগ্যপণ্য পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে।

বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম মহাসড়কে যানজটের জন্য সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং ট্রাফিক বিভাগের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন। তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চার লেনের মহাসড়কে যানজট কেন হবে? মন্ত্রণালয় ও ট্রাফিক বিভাগ করছে কী?’

হাতেম আরও বলেন, যানজটের কারণে প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দরে অনেকে রপ্তানিপণ্য শিপমেন্ট (জাহাজীকরণ) করতে পারছেন না। এ ছাড়া ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ভাড়া আড়াই তিন গুণ বেড়ে গেছে। শিপমেন্ট করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে অনেক রপ্তানিকারক সেই পণ্য আবার ঢাকায় ফেরত এনে আকাশপথে বিদেশি ক্রেতার কাছে পাঠাচ্ছেন। এটা রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য অশনিসংকেত।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ফেনীর দুর্ভোগ কমেছে
মঙ্গলবার দুপুরে ফেনীর ফতেহপুর রেলক্রসিং এলাকায় এক পাশের একটি উড়ালসড়ক চালু হওয়ায় মহাসড়কের ফেনী অংশে যানজট অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ৯ মে থেকে এই অংশে যানজট শুরু হয়েছিল। মঙ্গলবার চালু হওয়া উড়ালসড়ক দিয়ে ঢাকামুখী গাড়ি চলছে। কিন্তু চট্টগ্রামমুখী গাড়ি চলছে উড়ালসড়কের পার্শ্ববর্তী এক লেনের সড়ক দিয়ে। ২০ মে চট্টগ্রামমুখী উড়ালসড়কের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ফতেহপুর রেলক্রসিংয়ের ওপর উড়ালসড়ক নির্মাণ করছে।

গতকাল সরেজমিনে দেখা গেছে, এক পাশের উড়ালসড়ক খুলে দেওয়ায় ঢাকাগামী গাড়ি নির্বিঘ্নে চলছিল। কিন্তু চট্টগ্রামগামী গাড়িগুলো ভাঙা সড়ক দিয়ে ধীরে ধীরে পার হচ্ছিল। রেলক্রসিং এলাকায় খানাখন্দ সড়কের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০০ মিটার। ফলে ওই অংশে চট্টগ্রামগামী গাড়ির দেড়-দুই কিলোমিটার জট ছিল।

সীতাকুণ্ডের ১০ স্থানে জট
সীতাকুণ্ড পৌর সদরের বাইপাস, বাড়বকুণ্ড বাজার, পরীর রাস্তার মাথা, ফকিরহাট, কেডিএস লজিস্টিক, বিএম কনটেইনার ডিপো, কনফিডেন্স সিমেন্ট, মাদামবিবিরহাট বন বিভাগের চেকপোস্ট, ভাটিয়ারী বাজার, ফৌজদারহাট-বন্দর টোল সড়কের সংযোগস্থলসহ এলাকায় প্রায় নিয়মিত যানজট হচ্ছে। এসব জায়গায় শিল্পকারখানার মালামাল পরিবহনের সময় চলন্ত গাড়ি থমকে যায়। এ ছাড়া কারখানার পাশে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান এলোপাতাড়ি রাস্তায় পার্কিং করায় স্বাভাবিক গতিতে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়ে আসছে।

কুমিল্লায় ২৭ কিলোমিটার যানজট
গতকাল মহাসড়কে কুমিল্লার দাউদকান্দির মেঘনা-গোমতী সেতু এলাকা থেকে চান্দিনার মাধাইয়া পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটারে তীব্র যানজট ছিল। গত রোববার রাত আটটায় এই যানজটের সৃষ্টি।

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী কাভার্ড ভ্যানের চালক মো. নুরু গতকাল সকালে দাউদকান্দির শহীদনগরে বলেন, ‘মঙ্গলবার দিবাগত রাত তিনটায় কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার মাধাইয়া এলাকায় আটকে পড়ি। ২৪ কিলোমিটার পার হতে সাত ঘণ্টা লেগেছে।’

শিমরাইল থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড থেকে শিমরাইল পর্যন্ত এলাকায় প্রায় সারা দিন তীব্র যানজট ছিল। একজন যাত্রী প্রথম আলোকে বলেন, সকাল সাড়ে আটটায় তাদের বাস ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে সিলেটের উদ্দেশে ছেড়ে আসে। মহাসড়কের সানারপাড় পর্যন্ত প্রায় আট কিলোমিটার আসতেই সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে। দুপুরে বাসের ভেতর ঢুকে দেখা যায়, কষ্টে-ক্লান্তিতে বাসযাত্রীরা অনেকেই ঘুমিয়ে আছেন।

এই মহাসড়কের যানজট ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংকরোডসহ আশপাশের সড়কগুলোতে। উল্টো পথে যানবাহন চলাচলের কারণে যানজট প্রকট আকার ধারণ করে। সাইনবোর্ড, শিমরাইল পয়েন্টে বাস কাউন্টারগুলোতে বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীদের গাড়ির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে দেখা যায়।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন ফেনী প্রতিনিধি আবু তাহের, নারায়ণগঞ্জের মজিবুল হক, মিরসরাইয়ের ইকবাল হোসেন, সীতাকুণ্ডের কৃষ্ণ চন্দ্র দাস)