গুমবিষয়ক সনদ স্বাক্ষর প্রশ্নে ঢাকার অসম্মতি

গুম থেকে সবার সুরক্ষার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষরের বিষয়ে বেশ কয়েকটি দেশের সুপারিশ গ্রহণে বাংলাদেশ সম্মত হয়নি। এ ছাড়া নির্যাতন ও অমানবিক শাস্তি বন্ধের স্বেচ্ছামূলক অঙ্গীকারের দলিল (অপক্যাট), অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারবিষয়ক অতিরিক্ত অঙ্গীকার এবং রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারবিষয়ক স্বেচ্ছামূলক অঙ্গীকারের দুটি দলিল স্বাক্ষরের বিষয়েও একই রকম সুপারিশ গ্রহণে বাংলাদেশ রাজি হয়নি। এগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড বিলোপবিষয়ক।

জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের সর্বজনীন নিয়মিত পর্যালোচনা, যা ইউপিআর নামে পরিচিত, তার তৃতীয় দফা পর্যালোচনা সভায় এসব সুপারিশ উঠে আসে। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে গত সোমবার জেনেভায় এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ১০৫টি দেশের প্রতিনিধি বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে এসব সুপারিশ করেন।

সভায় উত্থাপিত সুপারিশগুলো চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ায় গতকাল বুধবার এগুলোর একটি খসড়া প্রকাশিত হয়।

প্রকাশিত খসড়ায় দেখা যায়, ১৬৭টি সুপারিশের বিষয়ে বাংলাদেশের সম্মতি রয়েছে। ২৩টি সুপারিশের বিষয়ে বাংলাদেশ তার মতামত জানানোর জন্য সময় নিয়েছে, যা ইউপিআরের পরবর্তী অধিবেশনের মধ্যেই জানাতে হবে। আগামী সেপ্টেম্বরে ইউপিআরের পরবর্তী সভার কথা আছে। ৬১টি সুপারিশের বিষয়ে বাংলাদেশের অসম্মতির কথা এই খসড়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সুপারিশগুলো সংখ্যায় অনেক হলেও বিষয় ও করণীয় বিবেচনায় অনেকগুলোই পুনরাবৃত্তি।

পুলিশ ও নিরাপত্তাবাহিনীর বিরুদ্ধে গুম, হেফাজতে নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগগুলো তদন্ত এবং দায়ীদের বিচারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার বিষয়ে যে সুপারিশ এসেছে, বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল সে বিষয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় চেয়েছে। মতামত জানাতে সময় নেওয়া বিষয়গুলোর মধ্যে আরও আছে, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা ও ডিজিটাল প্রযুক্তি আইনের খসড়া সংশোধন, সংখ্যালঘুদের আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা, বাল্যবিবাহ নিরোধক আইনে বিশেষ ছাড় দেওয়ার বিধি, কিশোরদের অপরাধের জন্য দায়ী করার ক্ষেত্রে বয়সসীমা বাড়ানো, দাম্পত্য জীবনে ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা, নারী-পুরুষের মজুরিবৈষম্য দূর করার মতো বিষয়গুলো। মীর আহমেদ বিন কাসেম এবং আমান আজমীর গুমের অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের তথ্য জানানোসহ নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে ওঠা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব অভিযোগ তদন্ত ও বিচারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সুপারিশের বিষয়েও বাংলাদেশ সম্মত হয়নি।

যেসব সুপারিশের বিষয়ে বাংলাদেশ অসম্মতি জানিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে গুমবিষয়ক সনদ ও ওপরে উল্লেখিত স্বেচ্ছামূলক অতিরিক্ত অঙ্গীকারের দলিল ছাড়াও আছে ১৯৫১-এর উদ্বাস্তুবিষয়ক সনদ, অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকারবিষয়ক আইএলও সনদ ১৩৮,১৩৯ ও ১৮৯, শিশুশ্রম নির্মূলবিষয়ক সনদ, নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্য অবসানের আইন, নিরাপত্তাবাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এখতিয়ার বাড়ানো, সমকামীদের সুরক্ষা এবং সে জন্য ফৌজদারি আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করার লক্ষ্যে সব ধরনের ফাঁসির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, মানহানির অভিযোগের ফৌজদারি দায় বাতিল, উদ্বাস্তু ও রাষ্ট্রহীন ব্যক্তিদের বিচারলাভের অধিকার নিশ্চিত করা ইত্যাদি।

যেসব বিষয়ে বাংলাদেশ সম্মত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কার্যক্রম এবং ব্যবস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানো, জাতীয় পর্যায়ে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে বিভিন্ন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, মানবাধিকার আন্তর্জাতিক সনদগুলোর সঙ্গে দেশীয় আইনগুলোর সামঞ্জস্য আনার চেষ্টা ত্বরান্বিত করা, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের বিষয়ে দ্বিতীয় ইউপিআরের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন, পার্বত্য চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণ বাস্তবায়ন, মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী করা, প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষা, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের হয়রানি ও হুমকির ঘটনাগুলো তদন্ত এবং তাদের সুরক্ষা, এ বিষয়ে পুলিশকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া, বৈষম্যবিরোধী আইন প্রণয়নের উদ্যোগ জোরদার করা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ, অনলাইন-অফলাইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের অধিকারসহ সব রাজনৈতিক গোষ্ঠীর জন্য গণতান্ত্রিক সুযোগ নিশ্চিত করা সম্পর্কিত সুপারিশ।

আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে এসব সুপারিশ চূড়ান্ত করার কথা রয়েছে।