পরিবহন-সংকট ও যানজটে বাড়ছে পণ্যের দাম

ঢাকামুখী মহাসড়কে নিশ্চল পরিবহন। বুধবার সকাল নয়টায় কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার শহীদনগর এলাকার দৃশ্য।  ছবি: প্রথম আলো
ঢাকামুখী মহাসড়কে নিশ্চল পরিবহন। বুধবার সকাল নয়টায় কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার শহীদনগর এলাকার দৃশ্য। ছবি: প্রথম আলো

রমজান মাসের চাহিদার তুলনায় এবার নিত্যপণ্যের আমদানি বেশিই হয়েছে। চাহিদা আর জোগানের সহজ এই হিসাব মেনে নিলে রোজায় পণ্যের দাম বাড়ার কথা নয়। কিন্তু এরপরও কথা থাকে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পণ্য পরিবহনের সমস্যা এখন প্রকট। এ ছাড়া এক সপ্তাহ ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ভয়াবহ যানজটও পণ্য পরিবহনে প্রভাব ফেলেছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাসের পর বাজারজাত করা পর্যন্ত পণ্যভেদে প্রতি কেজিতে বাড়তি খরচ পড়ছে ৩ থেকে ৫ টাকা।

পেঁয়াজ ছাড়া নিত্যপণ্যের বড় অংশই আমদানি হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। আবার চিনি ও ভোজ্যতেল ছাড়া রোজার পণ্যের সিংহভাগ কনটেইনারে করে বিদেশ থেকে আনা হয়। প্রতিবছর রোজার আগে মহাসড়কে পণ্যবাহী গাড়ির চলাচল বেড়ে যায়। এবার মহাসড়কে পণ্যবাহী গাড়ির ওজন নিয়ন্ত্রণে কড়াকড়ি আরোপ করায় গাড়ির চাহিদা দেড়গুণ বেড়েছে। এখন ছয় চাকার গাড়িতে (ট্রাক বা কাভার্ড ভ্যান) ১৩ টন পণ্য পরিবহন করা হয়। আগে কমবেশি ২০ টন পণ্য পরিবহন করা যেত।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগে যেখানে ৪০ টন পণ্য পরিবহনের জন্য দুটি গাড়ির প্রয়োজন হতো, এখন একই পণ্য পরিবহনে তিনটি গাড়ির দরকার হচ্ছে। গাড়ির সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি মহাসড়কের ফেনী অংশে যানজটের কারণে এক সপ্তাহ ধরে পণ্য পরিবহনে অতিরিক্ত সময় লাগছে। চাহিদা অনুযায়ী গাড়ি না পাওয়ায় পণ্য পরিবহনও কমে গেছে।

চট্টগ্রামের বৃহত্তম পাইকারি ব্যবসাকেন্দ্র খাতুনগঞ্জের কিং ট্রেডার্সের কর্ণধার পরিতোষ দে প্রথম আলোকে বলেন, ছয়টি গাড়ির দরকার হলে পাওয়া যাচ্ছে দুটি গাড়ি। ভাড়াও বেশি। পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কেজিপ্রতি ৬৭-৬৮ টাকার দেশি মসুর ডাল খাতুনগঞ্জে বিক্রি হচ্ছে ৭৩-৭৪ টাকায়।

পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে আন্তজেলা পরিবহন সংস্থা ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক সুফিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত শনিবার চট্টগ্রাম থেকে রওনা হয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠানের পণ্যবাহী পাঁচটি গাড়ি সোমবার রাতে ঢাকার মিরপুরে পৌঁছায়, যেখানে আগে ৬-৮ ঘণ্টা লাগত। যানজটের কারণে প্রতি ট্রাকের ভাড়া (ঢাকা-চট্টগ্রাম) পাঁচ হাজার টাকার বেশি বেড়েছে। এপ্রিল মাসে একটি ট্রাকের ভাড়া ছিল ২৪-২৬ হাজার টাকা। ১০ দিন ধরে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৩২ হাজার টাকা।

রোজায় নিত্যপণ্যের চাহিদা ও আমদানির চিত্র
রোজায় ছোলার চাহিদা থাকে ৮০ হাজার টন। গত ৪ মাসে আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার টন। খেজুরের চাহিদা থাকে ১৫ হাজার টন। গত ৪ মাসে এসেছে প্রায় ৪৩ হাজার টন। রোজায় ভোজ্যতেল দরকার হয় প্রায় আড়াই লাখ টন। শুধু এপ্রিলেই বাজারজাত হয়েছে ২ লাখ ৭৮ হাজার টন। রোজায় মসুর ও মটর ডালের চাহিদা থাকে ৪০ হাজার টন। এ দুটো পণ্যও পর্যাপ্ত আমদানি হয়েছে। চিনির চাহিদা আড়াই থেকে তিন লাখ টন। এর মধ্যে শুধু গত মাসে বাজারজাত হয়েছে আড়াই লাখ টন। এই তথ্য চট্টগ্রাম বন্দর, কাস্টমস ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পাওয়া।

বন্দরে আটকে আছে রোজার পণ্য
কনটেইনারে আসা রোজার অনেক পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে আছে। বন্দরের হিসাবে বেসরকারি ডিপোতে নিয়ে খালাস করতে হবে, এমন পণ্যবাহী কনটেইনারের সংখ্যা এখন সাড়ে তিন হাজার। এসব কনটেইনারে মসুর ডাল, ছোলা, মটর ডালসহ ৩৭ ধরনের পণ্য রয়েছে।

তবে বন্দর থেকে রোজার পণ্য সরবরাহে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে বলে জানান চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পর্ষদ সদস্য জাফর আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে যেখানে প্রতিদিন চার হাজার কনটেইনার বন্দর থেকে খালাস নিতেন আমদানিকারকেরা, এখন সেখানে আড়াই-তিন হাজার কনটেইনার খালাস নিচ্ছেন তাঁরা। বন্দর কর্তৃপক্ষ আমদানিকারকের কাছে পণ্য সরবরাহ দিতে ২৪ ঘণ্টা প্রস্তুত।

বন্দর কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি বেসরকারি ১৭টি ডিপোতে চাহিদানুযায়ী যন্ত্রপাতি সংকট আছে কি না, তা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে। এতে দেখা যায়, ১৭টি ডিপোতে ৭০টি কনটেইনার পরিবহনকারী গাড়ি এবং ৫৭টি কনটেইনার ওঠানো-নামানোর যন্ত্র কম আছে। গাড়ি ও যন্ত্রপাতি কম থাকায় বন্দর চত্বরে ডিপোগামী কনটেইনারের সংখ্যা বাড়ছে।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা হিসাব করে দেখেছেন বন্দর থেকে পণ্য খালাস করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছাতে এখন কেজিপ্রতি বাড়তি চার-পাঁচ টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। সরবরাহ-ব্যবস্থায় গতি ফেরানো না গেলে এই বাড়তি খরচ ভোক্তাদের গুনতে হবে।