নৌযানে দুর্ঘটনা এড়াতে সংকেত দেবে আমিরার যন্ত্র

চ্যাম্পিয়ন ট্রফি হাতে নিয়ে ইন্ডিকেটর উদ্ভাবক আমিরা খানম ওরফে আয়শা। মাদারীপুর, সাম্প্রতিক ছবি। ছবি: প্রথম আলো
চ্যাম্পিয়ন ট্রফি হাতে নিয়ে ইন্ডিকেটর উদ্ভাবক আমিরা খানম ওরফে আয়শা। মাদারীপুর, সাম্প্রতিক ছবি। ছবি: প্রথম আলো

নৌযানে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করলেই সংকেত দেওয়া শুরু করবে যন্ত্রটি। যাত্রীরা জেনে যাবেন, নৌযানটিতে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করা হয়েছে। নৌযানে দুর্ঘটনা এড়াতে ‘ওভারলোডিং ইন্ডিকেটর’ যন্ত্রটি এভাবেই কাজ করবে বলে দাবি করেছেন এর উদ্ভাবক মাদারীপুরের মেয়ে আমিরা খানম ওরফে আয়শা।

আমিরা দাবি করেন, যদি অতিরিক্ত যাত্রী বহন বা ওজনের কারণে লঞ্চ বা নৌযানটি দুর্ঘটনার কবলে পরে ডুবে যায়, তখনো সংকেতের মাধ্যমে নৌযানটিকে শনাক্ত করে দ্রুত উদ্ধারকাজ করা সম্ভব হবে।

তাঁর এ উদ্ভাবনটি চলতি বছর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে। আমিরা খানম (২৩) শরীয়তপুর জেড এইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। তিনি মাদারীপুর পৌরসভার শকুনি এলাকার আহসান হাবিব ও মিনারা খানমের বড় মেয়ে। ২০০৯ সালে মাদারীপুর টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেন। ২০১৪ সালে শরীয়তপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা শেষ করেন। ২০১৬ জেড এইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

আমিরার উদ্ভাবিত ইন্ডেকেটর সংযুক্ত নৌযানের মডেল। মাদারীপুর, সাম্প্রতিক ছবি। ছবি: প্রথম আলো
আমিরার উদ্ভাবিত ইন্ডেকেটর সংযুক্ত নৌযানের মডেল। মাদারীপুর, সাম্প্রতিক ছবি। ছবি: প্রথম আলো

আমিরা জানান, চলতি বছর ১২ ও ১৩ মে শরীয়তপুর জেড এইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় সহপাঠী আমির হামজাকে সঙ্গে নিয়ে নৌযানে ওভারলোডিং ইন্ডিকেটর উদ্ভাবন করে মেলায় প্রদর্শন করেন। মেলায় প্রদর্শিত এটি অন্যান্য উদ্ভাবনকে ছাপিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে। আমিরার এ উদ্ভাবনে অনুপ্রেরণা, মেধা ও শ্রম দিয়ে সহযোগিতা করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান মো. সোহেল রানা এবং প্রভাষক মো. জহিরুল ইসলাম।

কীভাবে ওভারলোডিং ইন্ডিকেটর কাজ করবে—জানতে চাইলে আমিরা জানান, কোনো লঞ্চ বা স্টিমারে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করলে আলো ও শব্দ সংকেতের (অ্যালার্ম) মাধ্যমে যাত্রীদের জানাবে যে এই নৌযান অতিরিক্ত যাত্রী বহন করে ঝুঁকি নিয়ে নৌপথে চলাচল করছে। একই সঙ্গে নির্দিষ্ট একটি মুঠোফোন নম্বরে কল চলে যাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত যাত্রী বা অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে নির্দিষ্ট ওজনে না আনা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ইন্ডিকেটর সার্কিট থেকে সংকেত দিতেই থাকবে। ঠিক একই সময় নৌযানে স্থাপিত ইন্ডিকেটর থেকে নিয়ন্ত্রণকক্ষে যুক্ত করা নম্বরে কল চলে যাবে। এটি ব্যবহার করে বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে এই কলের মাধ্যমে লঞ্চ বা নৌযানের ওভারলোডিংয়ের বিষয়টি মুহূর্তের মধ্যে জানা যাবে। এরপরও যদি অতিরিক্ত যাত্রী বহন বা ওজনের কারণে লঞ্চ বা নৌযানটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ডুবে যায়, তখনো সার্কিট থেকে কল যেতেই থাকবে। যতক্ষণ পর্যন্ত নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে সার্কিট ততক্ষণ পর্যন্ত সংকেত পাঠাতে থাকবে। ওই নম্বর ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে ডুবে যাওয়ার আগের স্থানটি কোথায় তা জানা সম্ভব হবে। ফলে উদ্ধারকাজ ত্বরান্বিত হবে এবং যাত্রীদের মৃত্যুঝুঁকি কম থাকবে।

স্বয়ংক্রিয় সার্কিট। এখান থেকে ওভারলোডিং সংকেত যাবে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। ছবি: প্রথম আলো
স্বয়ংক্রিয় সার্কিট। এখান থেকে ওভারলোডিং সংকেত যাবে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। ছবি: প্রথম আলো

আমিরা বলেন, এ সার্কিটে কিছু ইলেকট্রনিকস কম্পোনেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে এবং এটির সঙ্গে মোবাইল সিস্টেম ব্যবহার করার কারণে এটি অনেকটা সহজলভ্য। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। দেশের নৌযাত্রা নিরাপদ রাখাই ইন্ডিকেটর তৈরির মূল উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, ‘আমার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, ইচ্ছাশক্তি, কল্পনা ও মেধার বিকাশ ঘটিয়ে তা বাস্তবায়নে কাজটি করেছি। ভবিষ্যতে আরও আপডেট করে নতুন কিছু সংযুক্ত করার ইচ্ছা আছে। যাতে নৌপথে দুর্ঘটনা পুরোপুরি এড়াতে না পারলেও অনেকটা কমে আসবে। জীবনের ঝুঁকিও কমে আসবে। নৌপথে দুর্ঘটনা এড়াতে নৌযান নিরাপত্তায় আরও গবেষণা করে যাচ্ছি।’

আমিরার উদ্ভাবন সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান মো. সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমিরা একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। তিনি অনেক দিন ধরেই ওভারলোডিং ইন্ডিকেটর উদ্ভাবন তৈরিতে কাজ করেছেন। আমরা তাঁদের উৎসাহ ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের নৌযানগুলো ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে। নৌযান ও যাত্রীদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করেই আমিরা নৌযানে এই ইন্ডিকেটর সিস্টেম আবিষ্কার করেছে। তাঁর এই কাজ দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী উৎসাহ পাচ্ছেন।’