খুলনার অভিজ্ঞতায় গাজীপুরে 'ক্লিন' নির্বাচন চায় আ.লীগ

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়ের ধারাবাহিকতা গাজীপুরে ধরে রাখতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। গাজীপুরের আসন্ন নির্বাচনে জিততে প্রস্তুতিতে যেন কোনো কমতি না থাকে, সে জন্য তারা সজাগ। দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, খুলনার নির্বাচনে যেসব দুর্বলতা ছিল, তা তাঁরা নির্বাচনে কাটিয়ে উঠতে চান। আগের নির্বাচনে তাঁদের ভাষায় ‘সামান্য বিতর্ক’ তৈরি হয়েছে। এবার যেন তা না হয়, সে জন্য তাঁরা সজাগ। রাজধানীর কাছের এই সিটিতে জিততে তাঁরা ‘সিরিয়াস’।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, আগের নির্বাচনের চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন তাঁরা। খুলনার অভিজ্ঞতায় গাজীপুরে নতুন কিছু কৌশলও নির্ধারণ করছেন তাঁরা। তবে খুলনার নির্বাচন নিয়ে কিছু বিতর্ক হয়েছে স্বীকার করে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, খুলনার অভিজ্ঞতাকে তাঁরা কাজে লাগাবেন। তবে গাজীপুরের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পাশাপাশি ওই নির্বাচন যেন ‘ক্লিন’ থাকে, সেদিকে বিশেষ নজর দিচ্ছেন তাঁরা।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব গাজীপুরে যে ‘সিরিয়াস’, তার একটি প্রমাণ পাওয়া গেল গত রোববার। আওয়ামী লীগের এক ডজনের বেশি কেন্দ্রীয় নেতা টঙ্গীর স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেলের বাড়িতে সভা করলেন সেদিন। দলটির স্থানীয় ইউনিটের পক্ষ থেকে দেওয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সেখানে আলোচ্য বিষয় ছিল গাজীপুরের আসন্ন নির্বাচন। দলীয় প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমকে বিজয়ী করতে প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই এ সভা হয় বলেও জানানো হয়।

রোববারে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক, ফারুক খান, কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, দীপু মনি ও জাহাঙ্গীর কবির নানক, মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ, কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, মো. মুহিবুল হাসান নওফেল ও খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মো. আফজাল হোসেন, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ–বিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, গাজীপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আখতারুজ্জামান। রোববারের বৈঠকে স্থানীয় কাউকে ঢুকতেও দেওয়া হয়নি। সেখানে থাকা একাধিক নেতা বলেছেন, তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ কৌশল নিয়ে কথা বলেছেন।

এর আগে খুলনার নির্বাচনে কেন্দ্রীয় নেতারা গেছেন। তবে দল ধরে এত কেন্দ্রীয় নেতার এমন তৎপরতা ওই নির্বাচনে চোখে পড়েনি। গাজীপুরের এলাকা ধরে একেকজন নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। খুলনায় এমনটা ছিল না। কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন মনিটরিং করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। সে জন্যও নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে দেওয়া আছে। আবার গণমাধ্যম মনিটরিং ও প্রচারকাজের জন্যও কেন্দ্রীয় নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

কেন গাজীপুরকে এত গুরুত্ব দেওয়া? জবাবে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রাজ্জাক বলছিলেন, ‘গাজীপুর বিশাল এলাকা। দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প এলাকা এখানেই। দেশের এমন কোনো অঞ্চল নেই যেখানকার মানুষ এখানে নেই। এ নির্বাচনের বার্তা তাই সারা দেশে যাবে। এই নির্বাচনকে সিরিয়াসলি না নেওয়ার কোনো কারণ নেই।’

সাংসদ আবদুর রাজ্জাক যে ‘বার্তা যাওয়ার’ কথাটি বললেন, সেটি আওয়ামী লীগের বড় বিবেচ্য বিষয়। সেই বার্তা ইতিবাচক হওয়া ক্ষমতাসীন দলের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনও মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। কারণ, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গাজীপুরের নির্বাচনে বিজয় দলের নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করবে। আবার জনমতের ওপরও এর বড় প্রভাব পড়বে।

খুলনার মতো গাজীপুরে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ১৫ মে। এর আগে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক এক চেয়ারম্যানের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট নির্বাচন স্থগিত করেন। পরে এ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ ওই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেন। ২৮ জুনের মধ্যে নির্বাচনের আদেশ দেন। এখন গাজীপুরে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচার বন্ধ। শুরু হবে ঈদের পর ১৮ জুন থেকে। তবে নির্বাচন নিয়ে তোড়জোড় সরকারি দলে যথেষ্ট।

গাজীপুর নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রস্তুতির একটি অংশজুড়ে থাকছে স্থানীয়ভাবে দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটানো। নির্বাচনে পিছিয়ে যাওয়ার পেছনে দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল একটি বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হয়। আবদুর রাজ্জাক স্বীকার করেছেন, ‘স্থানীয় আওয়ামী লীগে কিছু সমস্যা আছে। কিছু দূরত্ব ও মতভেদ আছে। সেটি নিরসনে আমরা সচেষ্ট হয়েছি।’

খুলনার নির্বাচন আওয়ামী লীগকে আরেকটি ধারণা দিয়েছে। তা হলো ঐক্যবদ্ধভাবে দলটি কাজ করলে ভালো ফল আসে। খুলনায় এর আগের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পরাজয়ে দলীয় কোন্দল একটি অন্যতম কারণ ছিল। তবে এবার দলটির স্থানীয় সব পক্ষ এক হয়ে কাজ করেছে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলছিলেন, খুলনায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করায় ভালো ফল হয়েছে। আমরা সেই ধারাবাহিকতা রাখতে চাই।’

খুলনায় নির্বাচনের ফল এবং গাজীপুরের সম্ভাব্য কৌশল নিয়ে আওয়ামী লীগ ‘চুলচেরা বিশ্লেষণ’ করছে বলে জানান খালিদ মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘আমরা এ নির্বাচনে কোনো ফাঁক রাখতে চাই না।’

খুলনার নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থীকে নানাভাবে কোণঠাসা করে ফেলার অভিযোগ আছে সরকারি দলের বিরুদ্ধে। নির্বাচনের দিন অনেক কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্ট পাওয়া যায়নি। নির্বাচনের ফল বিএনপি প্রত্যাখ্যান করে ১৫০টি কেন্দ্রে নতুন করে ভোট গ্রহণের দাবি করে। ওই ফলাফল নিয়ে আওয়ামী লীগ কি বিব্রত? দলীয় সব নেতাই প্রকাশ্যে বলেছেন, ওই নির্বাচনে উন্নয়নের পক্ষে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রায় দিয়েছে। দলীয় প্রার্থী নির্বাচনও ভালো হয়েছিল বলে মনে করেন তাঁরা। সেই নির্বাচন নিয়ে ওঠা বিতর্ক নিয়ে আবদুর রাজ্জাকের মন্তব্য, প্রার্থীর বেশি সমর্থন থাকলে অতি উৎসাহে কিছু ঘটনা ঘটতে পারে। সেখানেও তা হয়েছে বলে মনে হয়।

আওয়ামী লীগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কেন্দ্রীয় নেতা প্রথম আলোকে বলেন, খুলনায় কিছু বিতর্ক উঠেছে। তবে এবার আরও ‘ক্লিন’ নির্বাচন করতে চান তাঁরা।

খুলনার চেয়ে গাজীপুর সিটির আয়তন অনেক বড়। এখানে ৫৭টি ওয়ার্ড। খুলনায় ছিল ৩১টি ওয়ার্ড। খুলনার ভোট ছিল প্রায় পাঁচ লাখ। গাজীপুরে ১১ লাখের বেশি। তাই এ নির্বাচনে বিশেষ প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলকে। আওয়ামী লীগের বিশ্লেষণ, খুলনার অনেক কৌশল এখানে কাজে লাগবে না। খুলনা একটি একক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শহর। খুব ভিন্নতা এখানে নেই। তবে গাজীপুরে টঙ্গীর মতো প্রচণ্ড জনবহুল শ্রমিক এলাকা আছে, জয়দেবপুরের মতো নাগরিক মানুষের শহর আছে আবার পূবাইলের মতো গ্রামীণ এলাকাও আছে। এই সিটি করপোরেশনকে তাই তারা বিভিন্ন ক্লাস্টারে (গুচ্ছে) ভাগ করতে চায়। আর একেক অংশের জন্য একেক রকম নির্বাচনী প্রচারের কৌশলও নেওয়া হবে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মুহিবুল হাসান নওফেল এ নির্বাচনে প্রচারের দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি বললেন, ‘সিটির যেসব এলাকায় এখন গ্রামীণ পরিবেশ আছে সেখানে উঠান বৈঠক করব আমরা। কিন্তু টঙ্গীর মতো এলাকায় এমন বৈঠকের সুযোগ নেই। সেখানে পথ সভাকেই প্রচারের কৌশল হিসেবে বেছে নেওয়ার ইচ্ছে আছে আমাদের।’

আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, নির্বাচনে বড় প্রস্তুতির অংশ হিসেবে নারী এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা করে ভোটের কৌশল নিয়েছে তারা। নারী ভোট আকৃষ্ট করতে ঘরে ঘরে যাওয়ার কৌশল নেওয়া হয়েছে। গাজীপুরের গত নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর হারে হেফাজতের আন্দোলনের একটি ভূমিকা ছিল। মুহিবুল হাসান নওফেল বললেন, ‘ধর্মীয় বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি মিটে গেছে। তাদের জন্যও আমাদের বার্তা থাকবে।’

আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, জাহাঙ্গীর কবীর নানক, আবদুর রাজ্জাক, দীপু মনি, ফারুক খান গাজীপুরের নির্বাচন দেখভালের জন্য বিশেষভাবে দায়িত্ব পেয়েছেন। এলাকা ভাগ করে তাঁদের দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছে। তাঁরা এলাকায় যেতে না পারলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকার দিকে দৃষ্টি রাখবেন।

দেশের বৃহত্তম সিটি করপোরেশন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের ব্যাপক প্রস্তুতি খুব সংগত বলেই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার। আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি নিয়ে যুক্তরাজ্যে পিএইচডি করেছেন অধ্যাপক মজুমদার। দলটির রাজনীতির পর্যবেক্ষণকারী এই বিশ্লেষক মনে করেন, খুলনার নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন দলের মনোবল এখন দৃঢ়। ওই নির্বাচনের পর সমালোচনার মাত্রা কোনো পরিসরে প্রবল হয়নি। যতটুকু হয়েছে তা তাদের গা সওয়া।’

অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলছিলেন, আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে বড় কোনো নির্বাচন বলতে গাজীপুরের নির্বাচন। সেই নির্বাচনে বিজয় জনমনকে (পাবলিক পারসেপশন) প্রভাবিত করবে। তার চেয়ে বড় বিষয় হলো দলীয় নেতা-কর্মীদের মনোবল। এ দুই নিশ্চিত করতে ভালো নির্বাচন করা এবং তাতে বিজয়ী হওয়া আওয়ামী লীগের কাছে বড় বিষয়।