জীবনযুদ্ধে কি হেরে যাবেন তাঁরা!

মোশারেফ শেখ ও নাজমা বেগম
মোশারেফ শেখ ও নাজমা বেগম

নাজমা বেগম এখন হাসপাতালে। মিরপুরের আজমল হাসপাতালে বারান্দায় শুয়ে আছেন। তাঁর আরেক নাম কাননবালা বণিক। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। গোপালগঞ্জ জেলার ভাজন্দি গ্রামে বেড়ে ওঠা এই নারীর জীবনযুদ্ধের সহযোদ্ধা মোশারেফ শেখ। তিনিও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। এ দুই বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবনের আত্মত্যাগের সব আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে তাঁদের অভাব-অনটন আর রোগ-শোকের কাছে। অসুস্থ এই দুই মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসার জন্য দোরে দোরে ঘুরছেন। সাড়া পাচ্ছেন না কোথাও। যেন তাঁদের জীবনের যুদ্ধ শেষ হচ্ছে না এখনো।

শুধু এঁরা নন, এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধাই এভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। যাঁদের এক বেলা ঠিকমতো খাবার জুটছে না, যাঁরা চিকিৎসা পাচ্ছেন না, সাহায্যের জন্য ঘুরে ঘুরে তাঁরা ক্লান্ত হয়ে পড়েন, একটু জিরিয়ে আবার ছোটেন, কিন্তু যুদ্ধ তাঁদের চলতেই থাকে।

গত রোববার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পেতে রাখা চেয়ারে একা একা বসে চোখের পানি ফেলছিলেন মোশারেফ শেখ। ছেঁড়া লুঙ্গি, জোড়াতালি দেওয়া শার্ট। বললেন, তাঁর সহযোদ্ধা স্ত্রী হাসপাতালে। আর বোধ হয় তাঁকে বাঁচাতে পারবেন না। চিকিৎসা করার মতো কোনো টাকা তাঁর কাছে নেই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রণালয়, আওয়ামী লীগ কার্যালয়, কত জায়গায় যে গেলেন। সবাই সাহায্য করবেন বলে আশ্বাসও দিলেন। কিন্তু না, কেউ এগিয়ে আসছেন না। তাহলে কি আর বাঁচাতে পারবেন না প্রিয়তমা স্ত্রীকে? মোশারেফ শেখ প্রশ্ন রাখলেন প্রতিবেদকের কাছে।

মোশারেফ শেখ জানালেন, তাঁর স্ত্রী বীরাঙ্গনা নাজমা বেগম কিডনির সমস্যাসহ নানা রোগে ভুগছেন। হাসপাতালের এক কোণে পড়ে আছেন। তিনি ভাতা পান মাসে ১০ হাজার টাকা। আর হাসপাতালের খরচ ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা। সুস্থ নন মোশারেফ শেখও। তাঁর গলা দিয়ে রক্ত পড়ে। যা ভাতা পান দুজনের খাওয়াদাওয়া চলে না, এরপর তো চিকিৎসা চালানো আরও কঠিন।

হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, নাজমা বেগম ক্লান্ত মুখ। চোখে ছানি পড়েছে। বেশি কথা বলতে পারেন না। অসহায় মুখে তাকিয়ে বলেন, ৪৭ বছর ধরে পড়ে আছি মিরপুরে মিল্ক ভিটা বস্তিতে। কে খবর নেয়? শুধু নানা দিবসে সাংবাদিকেরা এসে ভিড় জমান, টিভিতে নিতে চান। কিন্তু কেউ তাঁদের ভালোভাবে বাঁচার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন না।

এই দুই মুক্তিযোদ্ধা থাকেন মিরপুর-১০ নম্বর ঝুটপট্টি রোড শরণার্থী বিহারিদের বাসস্থান ৬ নম্বর ওয়াপদা বিল্ডিংয়ের পেছনে মিল্ক ভিটা কোম্পানির সীমানাদেয়ালঘেঁষা একটি ছোট্ট ছাউনি ঘরে। গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার গোহালা ইউনিয়নের মনিরকান্দি গ্রামে।

মোশারেফ শেখ প্রথম আলো কার্যালয়ে এসেছিলেন তাঁর স্ত্রীর অসুস্থতার সব কাগজপত্র নিয়ে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে স্মৃতিচারণা করে বলেন ১৯৭১ সালের মে মাসের এক রাতের কথা: ‘এই হিন্দু মেয়েটার (তাঁর স্ত্রী) বয়স তখন ১৮। ঠাকুরমার কাছে গল্প শুনছিল। ওই সময় হঠাৎ চিৎকার, গুলির আওয়াজ। আলবদর বাহিনী আর পাকিস্তানি হানাদাররা পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলে। এরপর যা হওয়ার তা-ই হলো। চিলের মতো টেনেহিঁচড়ে চোখ বেঁধে নাজমাকে নিয়ে যায়, লাথি দিয়ে ফেলে যায় ঠাকুরমাকে। যেতে যেতে ওদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ক্যাম্পে নিয়ে চলে পালা করে পাশবিক নির্যাতন। আমি বলতে গেলে একজন মরা মানুষ হয়েই বেঁচে রইলাম। মুক্তিযোদ্ধারা যখন নাজমাকে উদ্ধার করে তার পরিবারের কাছে নিয়ে গেল, কেউ তাকে গ্রহণ করতে রাজি হলো না। বলল, হিন্দুসমাজ এমন মেয়েকে মেনে নেবে না। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়ে থেকে গোপালগঞ্জের বাইনাচরের বীর বিক্রম হেমায়েত উদ্দিনের কাছে ট্রেনিং নিল। সেখানে সে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করত। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করার পাশাপাশি শিখল থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালনা এবং গ্রেনেড ছোড়া। এরপর সরাসরি যুদ্ধে থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালিয়ে অপারেশন করেছে নাজমা।’

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু নাজমা বেগমের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। মোশারেফ শেখ বলেন, ‘ওই অবস্থায় মেয়েটার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে খুব মায়া হচ্ছিল। পরে আমি নিজের ইচ্ছায় নাজমাকে বিয়ে করি। আগে নাম ছিল কাননবালা বণিক। ধর্মান্তরিত করে নাম হয় নাজমা বেগম। নাজমাকে বিয়ে করার পর আমার পুরো পরিবার আমাকে ত্যাগ করে, আমাকে ত্যাজ্য করে দেয়।...বাবা-মা বিহীন আরেক সংগ্রামী জীবন শুরু করি নাজমাকে নিয়ে। ৭১ সালে নাজমার ওপর এত অত্যাচার হয়েছিল, সে আর সুস্থ হয়ে উঠতে পারেনি। খেয়ে না খেয়ে বস্তিতে জীবন পার করছি। ইট ভাঙা, ঠেলাগাড়ি চালানোসহ রাজমিস্ত্রির কাজ একসময় করছি। এখন আর কিছু করতে পারি না।’

এত দিন তাঁদের মুক্তিযুদ্ধের সনদ ছিল না। তাই সরকারের কোনো সহায়তা পাননি। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর তাঁরা এই সনদ পান, যখন তাঁদের শরীরে কোনো জোর নেই। যা পান তা দিয়ে কোনোমতে চলেন। কিন্তু চিকিৎসা করতে পারেন না। স্বজনবিতাড়িত এই মুক্তিযোদ্ধা দম্পতি অনেক চেষ্টা করেছেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার। খুব ইচ্ছে তাঁকে একবার দেখার। আবেদনও করেছেন আর্থিক সাহায্যের জন্য। কিন্তু কিছুই পাননি। প্রশ্ন একটাই মোশারেফের—শেষ দিন পর্যন্ত কি ওই যুদ্ধ চলবে?