রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় খুলনায় মাদক ব্যবসা

>

• পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সাংসদ মিজানুর রহমানের নাম
• ছাত্রলীগের এক নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রীর দুই ভাইয়ের নামও আছে
• পুলিশের ৩৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পরোক্ষ সহায়তার অভিযোগ
• তালিকা পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে

রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় খুলনায় মাদক ব্যবসা চলছে। এ ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিদের সরকারদলীয় স্থানীয় সাংসদ মিজানুর রহমান পৃষ্ঠপোষকতা 

করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। পৃষ্ঠপোষক হিসেবে খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ানের দুই ভাইয়ের নামও রয়েছে। মাদক ব্যবসায় পুলিশের ৩৪ কর্মকর্তাও পরোক্ষভাবে সহায়তা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

মাদক ব্যবসায়ী ও তাঁদের পৃষ্ঠপোষকদের নিয়ে করা সরকারের তালিকায় এসব নাম পাওয়া গেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তালিকা পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে খুলনায় পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে ওই তালিকা পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

মাদক ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষক-আশ্রয়-প্রশ্রয়দানকারী হিসেবে তালিকায় খুলনা-২ আসনের সাংসদ ও খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমানের নাম রয়েছে। টেলিফোনে জানতে চাইলে সাংসদ বিস্ময় প্রকাশ করে জানতে চান, ‘কোন মাসের তালিকায় নাম এসেছে, আগের না এখনকার? আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।’

মাদকের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে প্রায়ই আপনার নাম এসেছে, দোষী না হলে কেন নাম আসে—জানতে চাইলে সাংসদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘দলের ভেতর থেকেও এসব ষড়যন্ত্র হতে পারে। আবার অন্য রাজনৈতিক দলের লোকজন এসব করতে পারে। আমি খালেক তালুকদারকে মেয়র হিসেবে জিতিয়ে এনেছি। এটা বোধ হয় কারও সহ্য হচ্ছে না।’ আপনি দোষী না হলে তালিকায় নাম আসা নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করেন না কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে সাংসদ বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তো আমাকে কিছু বলেনি। তাহলে কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করব?’

অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত ১৬ এপ্রিল সাংসদ মিজানুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যে অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে, তার মধ্যে মাদক ব্যবসার অভিযোগটি অন্যতম।

মাদক ব্যবসার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ওই তালিকায় খুলনা সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য শামসুজ্জামান মিয়া, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আনিসুর রহমান বিশ্বাসের নাম আছে। শামসুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেউ প্রভাবিত হয়ে এই তালিকায় আমার নাম লিখেছে।’

আর আনিসুর রহমানের ভাষ্য, ‘এই নামের তালিকা কারা দিল, কীভাবে এল, আমার জানা নেই। আমি তো রাজনীতিতে নেই। সরকারদলীয়ও নই।’ 

পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রলীগ নেতাদের নাম
তালিকায় মাদকের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে নাম আছে খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম আসাদুজ্জামানের। আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মাদকের তালিকায় তাঁর নাম কীভাবে এল এটি তিনি জানেন না। তিনি বলেন, শহরে মাদক সমস্যা আছে। মাদকের সঙ্গে জড়িতরা প্রকৃতপক্ষে কোনো দলের না। এরই মধ্যে পুলিশের সহায়তায় মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের কয়েকটি পরিবারকে তিনি উচ্ছেদ করিয়েছেন বলে দাবি করেন।

মাদকের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে নাম আছে কয়রা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাসুম বিল্লাহর। তিনি মাদক সেবন ও বিক্রি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে মাদক-সংক্রান্ত কোনো মামলা তাঁর নামে নেই। জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, এসব অভিযোগ মিথ্যা।

তবে কয়রা থানার একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মাসুম বিল্লাহ যে মাদকের সঙ্গে জড়িত, তা এলাকাবাসীর সবাই জানে। এ ছাড়া বিএল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রাকিব মোড়লের নামও আছে মাদকের পৃষ্ঠপোষকের তালিকায়। বিএল কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নিশাত ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, বিএল কলেজে ছাত্রলীগের বিশাল কমিটি। কলেজের দুটি হলে নিয়মিত বহিরাগতরা মাদকের আসর বসায়। স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতারা তাদের সহায়তা করেন।

পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সাবেক প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের ভাই শাহাবুদ্দিন ও ফুফাতো ভাই কাজী ইব্রাহিম মার্শালের নামও আছে। এ ব্যাপারে শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে হলে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে মার্শাল বলেছেন, ‘আমরা এ ব্যাপারে পুলিশ কমিশনারের কাছে আবেদন করব, কি করে আমাদের নাম আসল?’ আর এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি সাবেক প্রতিমন্ত্রী। 

মাদক ব্যবসায় দুই থানার ওসির নাম
খুলনা জেলা ও মহানগরে মাদক চোরাকারবার ও সরবরাহে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহায়তা করেন ৩৪ জন পুলিশ কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে জেলা পুলিশের দুই থানার দুই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) ১২ জনের নাম আছে। বাকি ২২ জন খুলনা মহানগর পুলিশে কর্মরত। তালিকায় থাকা দুই ওসি হলেন ফুলতলা থানার আসাদুজ্জামান ও দিঘলিয়া থানার হাবিবুর রহমান।

জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান তালিকায় তাঁর নাম আসা প্রসঙ্গে বলেন, ‘কেউ না কেউ শত্রুতা করে এটা করেছে, এটা আমি নিশ্চিত।’ দিঘলিয়া থানার ওসি হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমি তো আইনের ঊর্ধ্বে না, যদি জড়িত থাকি তবে কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।’

খুলনা মহানগরে মাদক চোরাকারবার ও সরবরাহে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তাকারী হিসেবে কেএমপির ২২ পুলিশ সদস্যের নাম রয়েছে। খুলনা মহানগর পুলিশের (কেএমপি) মুখপাত্র অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার সোনালী সেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তালিকায় যেসব পুলিশের নাম আছে, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। কেএমপির উপকমিশনাররা নিজ নিজ ইউনিটের তদন্ত করছেন।