জলাবদ্ধতা থাকবে না, অঙ্গীকার বাস্তবায়ন হয়নি, জনগণের সঙ্গে প্রহসনের দায় নেবে কে?

ভেনিসের খাল নয়, রাজধানীর সড়কপথ। বাস যখন বিকল, রিকশা যখন অপারগ, নগরের জলমগ্ন রাস্তায় নৌকাই তখন উদ্ধার। অঝোর বর্ষণের পরে গতকাল মিরপুরের কাজীপাড়ায়।  ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
ভেনিসের খাল নয়, রাজধানীর সড়কপথ। বাস যখন বিকল, রিকশা যখন অপারগ, নগরের জলমগ্ন রাস্তায় নৌকাই তখন উদ্ধার। অঝোর বর্ষণের পরে গতকাল মিরপুরের কাজীপাড়ায়। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

রাজধানীতে আয়োজিত বৈঠকে নগরবিদেরা বলেছেন, এ বছর আর জলাবদ্ধতা থাকবে না, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফের করা এই অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা হয়নি। তাঁরা প্রশ্ন করেন, জনগণের সঙ্গে এই প্রহসনের দায় কে নেবে?

জাতীয় প্রেসক্লাবে আজ শনিবার ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকারি উদ্যোগ ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকটির আয়োজন করে ঢাকা ইউটিলিটি রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডুরা)।

গতবার রাজধানীতে জলাবদ্ধতার ভয়াবহতা দেখে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, ‘আমি প্রমিজ করছি, সামনের বছর থেকে আর এসব (জলাবদ্ধতা) দেখবেন না।’ তবে মন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিফলন দেখা যায়নি ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্বে থাকা ঢাকা ওয়াসা এবং দুই সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমে।

বৈঠকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, ঢাকা ওয়াসা, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), গণপূর্ত অধিদপ্তরসহ পরিবেশবাদী সংগঠনের প্রতিনিধি, নগর পরিকল্পনাবিদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক অংশ নেন।

বৈঠকে নাগরিক প্রতিনিধিদের অভিযোগ, জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাগুলো নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সরকারি সংস্থার কর্মকর্তাদের জবাবদিহি না থাকাই এর বড় কারণ।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, জলাবদ্ধতা এখন ভালো একটি বাণিজ্য। যত বড় প্রকল্প, সরকারি কর্মকর্তাদের তত লাভ। তাঁদের কোনো ধরনের দায়বদ্ধতা না থাকায় দিনে দিনে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে বড় ভূমিকা আছে রাজউকের, কিন্তু তারা তাদের মূল কাজ বাদ দিয়ে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে।

পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবিব বলেন, প্রতিবছর হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে শুধু প্রতিশ্রুতি দিলে হবে না। সমন্বিতভাবে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়ন করতে হবে। একটি সংস্থার অধীনে পুরো পানিনিষ্কাশনব্যবস্থাকে নিয়ে আসতে হবে। জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি ছাড়া জলাবদ্ধতার সমাধান সম্ভব না।

৯ বছর ধরে একই দল ক্ষমতায় থাকলেও জনদুর্ভোগ কমাতে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে মনে করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, ‘বড় বড় স্থাপনা মানেই কি উন্নয়ন? নাগরিক হিসেবে ভালো সেবা পাচ্ছি কি না, সেটি বিবেচনা করতে হবে না?’

বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সহসভাপতি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ। তাতে বলা হয়, রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা এবং ওয়াসার ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারা জলাবদ্ধতার মূল কারণ। পানিনিষ্কাশনের নালা পরিষ্কার না থাকা, খালের বেহাল, বৃষ্টির পানি ধারণস্থান না থাকায় জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করছে।

রাজধানীর খালগুলো দখল ও দূষণে সংকুচিত হয়েছে বলে স্বীকার করে নেন ওয়াসার পরিচালক এ কে এম শহীদ। তিনি বলেন, খালগুলো দখলমুক্ত ও পুনঃখনন করতে ওয়াসা উদ্যোগ নিয়েছে। ২০১১ সাল থেকে ওয়াসা পানিনিষ্কাশনব্যবস্থাকে এক সংস্থার অধীনে করার প্রস্তাব দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

পুরো বৈঠকেই বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) বাস্তবায়নে রাজউকের ব্যর্থতার সমালোচনা করেন আলোচকেরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে নতুন ড্যাপের পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ড্যাপে চিহ্নিত পানি ধারণ ক্ষেত্রে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা আবাসন প্রকল্পের বিরুদ্ধে রাজউক আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, সেটির রূপরেখা পরিকল্পনা ছিল না।

বৈঠকে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সামগ্রিক মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, স্বল্পমেয়াদি ও নিয়মিত কার্যক্রম যথাযথভাবে পালনের সুপারিশ করা হয়। আলোচকেরা বলেন, রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে দক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রয়োজন।

বিআইপির সাধারণ সম্পাদক আদিল মোহাম্মদ খানের সঞ্চালনায় বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সচিব দুলাল কৃষ্ণ সাহা, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান ও ফারহানা ইসলাম, গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান মুন্সি প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য দেন ডুরার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন।