মেধার ছটায় গরিবি ম্লান

সুবর্ণা রানী দাস,রিপন আতিকুল ,সাদিয়া ইসলাম ও রনি মোল্লা
সুবর্ণা রানী দাস,রিপন আতিকুল ,সাদিয়া ইসলাম ও রনি মোল্লা

রাজবাড়ীর সুবর্ণা রানী। একে তো দরিদ্র পরিবারের সন্তান, তার ওপর জন্মান্ধ। বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার রিপন আতিকুল। বাবার উপার্জনে সংসার না চলায় কিশোর বয়সে রাজমিস্ত্রির সহকারীর কাজ করে। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার সাদিয়া ইসলাম। মায়ের সঙ্গে অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। নাটোর সদর উপজেলার রনি মোল্লা। সবজি বিক্রেতা বাবার সঙ্গে মাঝেমধ্যেই যেতে হয় সবজি বিক্রি করতে। এসব প্রতিকূলতা জয় করে চারজনই এবার এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে।

সুবর্ণা পৃথিবীর আলো দেখেনি

রাজবাড়ী সদর উপজেলার চন্দনী ইউনিয়নের হরিণধরা গ্রামের সুবর্ণা রানী জন্মের পর থেকে পৃথিবীর আলো দেখেনি। সুবর্ণার বয়স যখন দুই বছর, তখন তার বাবা সুভাষ চন্দ্র দাস মারা যান।

মা কণিকা রানী বিশ্বাস প্রথম আলোকে জানান, স্বামী মারা যাওয়ার পর কাঁথা সেলাই করেই সংসার চালানো শুরু করেন। এর মধ্যে পড়ালেখার প্রতি সুবর্ণার প্রবল আগ্রহের কারণে তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। প্রায় দুই কিলোমিটার পথ হেঁটে মেয়েকে নিয়ে স্কুলে আনা-নেওয়া করতেন তিনি। রোদে পুড়েছেন, বৃষ্টিতে ভিজেছেন। পরনের ভেজা কাপড় শরীরেই শুকিয়েছেন। মেয়েকে ঠিকমতো খেতে দিতে পারেননি। স্কুল শেষ হলে মেয়েকে শিল্পকলা একাডেমিতে ক্লাসে নিয়ে যেতেন। অনেক দিন দুপুরে খাওয়াও হয়নি।

সেই সুবর্ণা জেলা শহরের ইয়াছিন উচ্চবিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। সুবর্ণা ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ালেখা করে। পরীক্ষায় একজন শ্রুতলেখক দিয়ে তার প্রশ্নোত্তর লেখানো হয়। এবার এসএসসি পরীক্ষায় ওই স্কুল থেকে একমাত্র সুবর্ণাই জিপিএ-৫ পেয়েছে।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাইদা খাতুন বলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি সুবর্ণা শিল্পকলা একাডেমি থেকে চার বছর মেয়াদি উচ্চাঙ্গসংগীত প্রশিক্ষণ শেষ করেছে। এখন আবৃত্তির প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে গান ও কবিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে সে।

রিপন রাজমিস্ত্রির সহকারী

দুপচাঁচিয়ার তালোড়া শাবলা গ্রামে রিপনের বাড়ি। বাবা ইয়াকুব আলী ঢাকায় রিকশা চালান। বাবার উপার্জনে সংসার না চলায় সপ্তাহে দুই দিন স্কুলে না গিয়ে রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করে রিপন। তালোড়া আলতাফ আলী উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র রিপন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে। পরীক্ষার পর থেকে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হওয়াসহ প্রয়োজনীয় খরচ জোগাতে রাজমিস্ত্রির কাজ করে যাচ্ছে রিপন।

বাবা ইয়াকুব আলী জানান, সম্পদ বলতে টিনের ছাপরা দেওয়া মাটির দুটি ঘর। তাঁর বড় ছেলে রাশেদুল ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। তিনিও ২০০৭ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। প্রথম আলো ট্রাস্টের বৃত্তি নিয়ে লেখাপড়া করেছেন তিনি।

তালোড়া আলতাফ আলী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সামছুল ইসলাম বলেন, ‘রিপনদের অবস্থা দেখে আমরা কোনো বেতন নিইনি। ওর ভাই রাশেদুলও মেধাবী ছাত্র ছিল।’

সাদিয়া পড়ার ফাঁকে গৃহকর্মী

বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার শ্যামলীপাড়া গ্রামে। বাবা হাফিজুর রহমান দিনমজুর। বেশ কিছুদিন থেকে তিনি অসুস্থ (পক্ষাঘাতগ্রস্ত)।

সাদিয়ার মা মরিয়ম বেগম জানান, স্বামীর আয় না থাকায় তিনটি বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন তিনি। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে সাদিয়াও গৃহকর্মী হিসেবে তার সঙ্গে কাজ করত। সে জন্য মাঝেমধ্যে তার স্কুলে যাওয়া হতো না।

উল্লাপাড়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে সাদিয়া। তার মা মরিয়ম বলেন, ‘মেয়েটিকে কোনো দিন ভালো খাবার, কাপড়চোপড় দিতে পারিনি। খেয়ে না-খেয়েই দিন কেটেছে। এত কষ্টের মধ্যেও পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পায় সে। দুটি পরীক্ষাতেই বৃত্তি পাওয়ায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বেতন লাগেনি তার। তাকে কখনো প্রাইভেট পড়াতে পারিনি। কয়েক বছর ধরে স্বামী পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী। এক শতক ভিটের ওপর একটি ছাপরা ঘরে কোনোরকমে বাস করছি।’

সাদিয়ার বড় বোন বগুড়া আজিজুল হক কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। টিউশনি করে তিনি নিজের খরচ চালান।

পেটে ক্ষুধা নিয়ে পড়েছে রনি মোল্লা

নাটোর সদর উপজেলার আগদীঘা গ্রামে টিনের ছাউনি ও পাটকাঠির বেড়ার তিনটি ঘরে রনিদের সাত সদস্যের পরিবারের বাস। বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী ও তিন ছেলের এই সংসার চালান রনির বাবা মো. আলেক মোল্লা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ডালা মাথায় নিয়ে গ্রামে গ্রামে সবজি বিক্রি করেন। ছোট ছেলে রনি এবার গ্রামের আগদীঘা উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। রনিসহ তাঁর তিন ছেলেই মেধাবী। বড় ছেলে রবিউল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ বর্ষে এবং মেজ ছেলে নয়ন আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়েন।

রনি মোল্লা জানায়, বড় দুই ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ জোগাতে গিয়ে বাড়িতে দুবেলা খাবার জুটত না। ক্ষুধা পেটে থাকলেও পড়ালেখায় অবহেলা করেনি রনি। পড়ালেখার পাশাপাশি বাবাকে সাহায্য করতে সে নিজেও মাঝেমধ্যে হাটে সবজি বিক্রি করতে যায়। আলেক মোল্লা জানান, বাড়ির ভিটা ছাড়া কোনো সম্পত্তি নেই তাঁর। তাই ছেলেদের পড়ালেখা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন প্রতিনিধি, রাজবাড়ী, দুপচাঁচিয়া,বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর]