মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করতেই ১০ বছর পার

টানা প্রায় ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে পারেনি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এ পর্যন্ত নতুন করে সরকারি গেজেটভুক্ত হয়েছেন আরও ৩১ হাজার ৫৪৯ জন। একই সময়ে ভাতা পাওয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাও ১ লাখ থেকে বেড়ে ১ লাখ ৮৬ হাজার হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে ৪৭ বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে শুধু সংখ্যাযুদ্ধই চলছে।

গত বছরের (২০১৭ সাল) জানুয়ারি মাসে ঢাকঢোল পিটিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করে সরকার। নতুন করে প্রায় দেড় লাখ আবেদন আসে। সরকার চেয়েছিল তাদের মধ্যে পাঁচ হাজার জনকে অন্তর্ভুক্ত করতে। কিন্তু যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন থেকে শুরু করে পুরো প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় শেষ পর্যন্ত নতুন তালিকা প্রকাশ স্থগিত করতে বাধ্য হয় সরকার। অথচ শুধু কয়েক মাসের এই কাজের জন্য চার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন কোনো তালিকা তৈরির কাজ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকেরা বলছেন, এই সরকারের ১০ বছরে প্রকৃত ও নির্ভুল তালিকা করতে না পারাটা শুধু ব্যর্থতাই নয়, অদক্ষতাও বটে। এ ছাড়া যাচাই-বাছাইকে কেন্দ্র করে যে অনিয়ম ও টাকার লেনদেন হয়েছে, তা মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করেছে। আর শেষ পর্যন্ত তালিকা না করে কার্যত তাঁদের অসম্মান করা হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বাড়ছেই

সরকার পরিবর্তন হলেই মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। ৪৭ বছরে এ পর্যন্ত ছয়বার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড পাল্টেছে ১১ বার। সর্বশেষ গত ১৬ জানুয়ারি মন্ত্রণালয় পরিপত্র জারি করে জানায়, ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বরে যেসব মুক্তিযোদ্ধার বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ৬ মাস ছিল, তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এর আগে ২০১৭ সালের ১৯ জুন জারি করা পরিপত্র অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা বিবেচনার ন্যূনতম বয়স ছিল ১৩ বছর। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার এই বয়সসীমা দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক চলছে।

সম্মানী ভাতা বছরে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, খেতাবপ্রাপ্ত, যুদ্ধাহত ও শহীদ ও সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রতিবছর প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি সম্মানী ভাতা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০০৮-০৯ সালে ১ লাখ মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেলেও ২০১৭-১৮ সালের হিসাবে ভাতা দেওয়া প্রায় ১ লাখ ৮৬ হাজার জনকে। ২০০৯ সালে মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা ছিল ৯০০ টাকা করে। তা বাড়িয়ে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ১০ হাজার টাকা করেছে সরকার। এ ছাড়া দুটি উৎসব ভাতা পান তাঁরা।

গত ১০ বছরে মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁর সন্তানদের সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫ শতাংশ, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য আবাসন, রেশনসুবিধা, চিকিৎসা খরচ, গৃহকর মওকুফসহ বিভিন্ন সুবিধা বাড়িয়েছে সরকার।

তবে সঠিকভাবে তালিকা না হওয়ার সুবিধা ও ভাতা পাওয়া ব্যক্তিদের সবাই মুক্তিযোদ্ধা কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের অর্ধেকই মারা গেছেন। আবার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেকেই এই সুবিধার আওতায় আসতে পারেননি, তাহলে কারা এসব ভাতা পাচ্ছেন? ভাতাভোগীর পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য প্রকৃত তালিকার দরকার ছিল।

শাহরিয়ার কবির বলেন, এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে আওয়ামী লীগ সরকার ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই তালিকা চূড়ান্ত করতে পারল না। ২০০৯ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়সসীমা প্রথমে দুই বছর এবং পরে আরও এক বছর বাড়ায় সরকার। এরপরই নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ার হিড়িক পড়ে যায়।