সংগ্রাম থেকে সাফল্যে

কমল চন্দ্র রায়, মো. আয়াতুল্লাহ, গৌরব দাশ ও মরিয়ম আক্তার
কমল চন্দ্র রায়, মো. আয়াতুল্লাহ, গৌরব দাশ ও মরিয়ম আক্তার
>কমল চন্দ্র রায়ের হাতে একটিও আঙুল নেই। কিন্তু কলম চালিয়েছে সপাটে। একাধারে গাছি ও ভাটাশ্রমিক মো. আয়াতুল্লাহ তার প্রধান শিক্ষকের দেখা সেরা ছাত্র। দিনমজুর বাবার ছেলে গৌরব দাশ এবং এক গৃহকর্মী মায়ের মেয়ে মরিয়ম আক্তার নিজেদের পড়ার খরচ জুগিয়েছে টিউশনি করে। এই চারজনই এবার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে।


আঙুল ছাড়াই কলম চালায় কমল
নিজে শারীরিক প্রতিবন্ধী। বাবা নেই। পরিবারে অভাব-অনটন। সব প্রতিবন্ধকতা পায়ে দলে এগিয়েছে সে। বাবা শরণার্থী রায় ছিলেন কৃষিশ্রমিক। ১৪ বছর আগে বজ্রপাতে মারা যান। কমল তখন দুই বছরের শিশু।

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার সাহাপাড়া গ্রামে কমলের বাড়িতে গিয়ে সর্বত্র দারিদ্র্যের ছাপ চোখে পড়ল। প্রতিবেশীরা জানালেন, কমলের মা লিলি রায় (৫৫) দিনমজুরির কাজে মাঠে গেছেন। কমল গিয়েছে স্কুলে। প্রতিবেশীরাই খবর দিয়ে আনলেন মা-ছেলেকে। লিলি রায় জানালেন, তাঁদের জমিজমা নেই। তিন ছেলে। কমল সবার ছোট। বড় ছেলে লিটন চন্দ্র রায় (২৫) দিনমজুর। বিয়ে করে আলাদা সংসার করছেন। মেজ ছেলে মিলন চন্দ্র রায়ও (২২) দিনমজুর। মিলন ও তাঁর (লিলি) আয়ে চলে সংসার।

জন্মগতভাবে কমলের দুই হাতে আঙুল নেই। পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়ে ভর্তি হয় গোবিন্দ আইডিয়াল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে।

কমল রায় বলে, ‘আঙুল না থাকায় কলম ধরতে অনেক কষ্ট হয়। শত কষ্ট হলেও লেখাপড়া চালিয়ে যাব। একজন আদর্শ চিকিৎসক হতে চাই।’ প্রতিবন্ধী কমলকে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দেন বিদ্যালয়ের পরিচালক ও শিক্ষক গোবিন্দ চন্দ্র রায়। পাশাপাশি স্কুলে যাতায়াতের জন্য তাকে কিনে দেন বাইসাইকেল। গোবিন্দ চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমলের আছে অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর মেধা। তার সহযোগিতা দরকার।’ 

ইটভাটাতেও কাজ করেছে আয়াতুল্লাহ
একদিকে সংসারের খরচ, অন্যদিকে পড়াশোনার ব্যয়। কূলকিনারা দেখত না আয়াতুল্লাহ। বছরজুড়ে তিন ধরনের কাজ করছে সে। কখনো নারকেলগাছ পরিষ্কার করা (বাছা), কখনো মাছ ধরা এবং মৌসুমে ইটভাটায় কাজ করা। ঘাম ঝরানো সব কাজ। এর মধ্যেই পড়াশোনা চলেছে। সবাইকে চমকে দিয়ে ব্যবসায় শিক্ষা শাখা থেকে পেয়েছে জিপিএ-৫।

আয়াতুল্লাহ পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার পুরান মহিপুর গ্রামের বাসিন্দা। ঘর বলতে ছোট্ট একটি খুপরি। সে জানায়, তাদের জমিজমা নেই। বাবা মোস্তফা মৃধা ঢাকার রামপুরায় বাবুর্চির কাজ করেন। তবে তিনি উচ্চ রক্তচাপসহ নানা রোগে ভুগছেন। যা আয় করেন, নিজের ওষুধসহ ভরণপোষণেই খরচ হয়ে যায়। মা শাহিনুর বেগম যক্ষ্মা রোগী।

আয়াতুল্লাহ পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষায়ও জিপিএ-৫ পেয়েছে। এসএসসি পরীক্ষার আগে পরিবারের দুর্দশাটা বেড়ে যায়। মায়ের যক্ষ্মা ধরা পড়ে। এসএসসি পরীক্ষার মাস তিনেক আগে ইটভাটার কাজ নেয় আয়াতুল্লাহ। সে কলাপাড়ার মহিপুর কো-অপারেটিভ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবদুস ছালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আয়াতুল্লাহ আমার শিক্ষকজীবনে দেখা সেরা ছাত্র।’

স্কুলের জন্য গৌরব বয়ে এনেছে গৌরব
নাম গৌরব দাশ। নিজের স্কুলের জন্যও বয়ে এনেছে গৌরব। স্কুলের প্রথম ছাত্র হিসেবে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। সেই ছেলেই পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে।

গৌরব বলল, ‘আমাদের সাত সদস্যের পরিবারের মুখে দুই বেলা ঠিকমতো ভাতই জোটে না। নিজে কখনো প্রাইভেট পড়তে পারিনি। তবে সংসার চালাতে আমি অন্যদের পড়িয়েছি। স্কুলে তো বিনা খরচে পড়েছি। বাবা বলে দিয়েছেন, কলেজে পড়ানোর সামর্থ্য তাঁর নেই।’

গৌরব দাশের বাড়ি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার আবদুল্লাহপুর গ্রামে। বাবা গোপাল দাশ দিনমজুর। মা শিল্পী রানী দাশ গুরুতর অসুস্থ। গৌরবরা তিন ভাই ও এক বোন। দাদি আছেন। সাত সদস্যের পরিবারে গোপাল দাশই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আয়ের বেশির ভাগই চলে যায় স্ত্রীর চিকিৎসায়।

শান্তিগঞ্জ মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গৌরবের জন্য আমরা যেটুকু করেছি, দায়িত্ব মনে করেই করেছি। গৌরব আমাদের স্কুলের প্রথম শিক্ষার্থী হিসেবে জিপিএ-৫ পেল। এটা আমাদের জন্য গৌরবের বিষয়।’ 

চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন মরিয়মের
চাঁদপুর পৌরসভা পরিচালিত পীর মহসিন উদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানের একমাত্র শিক্ষার্থী হিসেবে এবার এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে মরিয়ম আক্তার। বিদ্যালয় তাকে নিয়ে গর্ব করতেই পারে। তবে আসল গর্ব মরিয়মের ও তার মা মাফিয়া বেগমের। তাদের কাছে এ এক দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল।

মরিয়ম জন্ম নেওয়ার পরপরই মাফিয়াকে ছেড়ে চলে যান স্বামী আক্তার হোসেন। মরিয়মসহ তিন সন্তানকে নিয়ে মাফিয়ার জীবনযুদ্ধের সেই শুরু। চাঁদপুর শহরের তালতলা বকাউল বাড়ি রোডে চাচাতো ভাইয়ের ভাড়া বাসায় ওঠেন তিনি। সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ ও দুবেলা ভাত জোগাতে অন্যের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ নেন।

মরিয়ম বলল, ‘আমি নবম শ্রেণিতে ওঠার পর মায়ের কষ্ট সত্যিকারভাবে বুঝতে পারি। তখন বাসায় বাসায় টিউশনি শুরু করি। কিন্তু আমি নিজে কখনো প্রাইভেট পড়িনি।’ চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন মরিয়মের।

(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, সুনামগঞ্জ; প্রতিনিধি, নীলফামারী, চাঁদপুরকলাপাড়া)