ঢাকা, খুলনা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বসেছিল স্বপ্নের দোকান

স্বপ্নের দোকান থেকে জামা নিচ্ছে শিশুটি। ছবি: মানসুরা হোসাইন
স্বপ্নের দোকান থেকে জামা নিচ্ছে শিশুটি। ছবি: মানসুরা হোসাইন

ঈদে জাকাত, ফিতরা, দান-খয়রাতসহ বিভিন্ন সহায়তা পায় শহরের ছিন্নমূল শিশুরা। কিন্তু ঈদের জন্য শপিং বা কেনাকাটা করা, তাও আবার নিজের পছন্দের মতো, তা কিন্তু ভাগ্যে একদমই জুটে না এসব শিশুদের। অথচ তাদেরও ইচ্ছে করে নিজেদের পছন্দ মতো ঈদ শপিং করতে।

এ ধরনের চিন্তাভাবনা থেকেই গত বছর যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘স্বপ্নের দোকান’ এর। এর উদ্যোক্তা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাঈম অঙ্কুর।

আজ শনিবার রাজধানীর আটটি জায়গা এবং ঢাকার বাইরে খুলনা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বসেছিল স্বপ্নের দোকান। ফুটপাতে শিশুদের রং-বেরঙের জামা নিয়ে বসেছিলেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। ফুটপাতে বা রাস্তায় থাকা শিশু ও তার বাবা মায়েরা প্রথমে একটু একটু করে সামনে এগিয়ে আসেন। আর এগিয়ে আসলেও কিছু বলার সাহস পাচ্ছিলেন না, বুঝতে পারছিলেন না জামাগুলোর দাম কত হবে। তাঁদের এমন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মাঝখানে স্বেচ্ছাসেবকেরা আস্তে আস্তে শিশুদের জামা পছন্দ করতে বলেন।

সাহস পেয়ে শিশু ও তাদের মা-বাবারা নিজেদের পছন্দের জামা বাছাই করতে শুরু করেন। বাছাই শেষে জানতে চান, দাম কত? তখন স্বেচ্ছাসেবকেরা জানান, কোনো দাম দিতে হবে না। শিশুরা জামা পেয়ে যে হাসি দিচ্ছে সেটিই জামার বিনিময়মূল্য। তখন শুধু শিশু নয়, নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া অভিভাবকদের মুখেও হাসি ফোটে। স্বেচ্ছাসেবকেরা জানান, স্বপ্নের দোকানের বিনিয়োগ এবং লাভ— দুটোই হলো শিশুর হাসি।

এই স্বপ্নের দোকানের ক্রেতা হওয়ার শর্ত একটাই, শিশুদের সরাসরি উপস্থিত হতে হবে। কোনো শিশু উপস্থিত হলো, কিন্তু তার পছন্দ মতো জামা পেল না, তখন শিশুটির মন যাতে খারাপ না হয় সে জন্য অভিভাবকের হাতে তুলে দেওয়া হয় টাকা। স্বপ্নের দোকানের এসব কর্মকাণ্ডে কোনো কোনো অভিভাবকদের চোখেমুখে আফসোসের ছায়াও ধরা পরে। কারণ তিনি তাঁর একটি সন্তানকে নিয়ে এসেছেন, আরেকটিকে যে বাসায় রেখে এসেছেন। আর যাঁদের থাকার জায়গা কাছের বস্তিতে, তারা মুহূর্তের মধ্যে ছুটে গিয়ে সন্তানদের নিয়ে এসেছেন।

আজ সকাল ১১টা থেকে শুরু হয় স্বপ্নের দোকানের কেনাবেচা। মোহাম্মদপুরে পুরোনো থানা রোডের ফুটপাতে দোকানে বসেন স্বপ্নের দোকানের উদ্যোক্তা নাঈম অঙ্কন, তাঁর মা ফাহমিদা জামানসহ পরিবারের চাচি ও অন্যান্য সদস্যরা। ছিলেন নাঈমের বন্ধুরাও।

নাঈম প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর তাঁর দেখা একটি দৃশ্য থেকেই মূলত এ ধরনের দোকান দেওয়ার পরিকল্পনা মাথায় আসে। তিনি বলেন, দোকানের বাইরে দুই শিশু একটি নাটকে অভিনয় করে। এদের মধ্যে একজন দোকানদার আর আরেকজন ক্রেতার ভূমিকায় অভিনয় করে। ক্রেতা জামা পছন্দ করে এবং পকেট থেকে টাকা বের করে দেয়, বিক্রেতা টাকা গুণে জামার প্যাকেট ক্রেতার হাতে ধরিয়ে দেয়। এখানেই নাটকের সমাপ্তি। তারপর দুই শিশু যার যার কাজে চলে যায়। তখনই মনে হয়, এই শিশুদেরও নিশ্চয়ই নিজের পছন্দের জামা কিনতে ইচ্ছে করে। সেবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এ চিন্তার কথা শেয়ার করলে পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুরা এগিয়ে আসেন। বছরটিতে শুধু রাজধানীর একটি জায়গায় স্বপ্নের দোকানে শিশুদের জামা দেওয়া হয়।

নাঈম বলেন, স্বপ্নের দোকানে জামা কিন্তু শিশুদের দান করা হয় না। তারা দোকানের সম্মানিত ক্রেতা। তাদের পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। জামা হাতে পেয়ে শিশুরা যে হাসি দেয় তাই হলো স্বপ্নের দোকানের বিনিয়োগ ও লাভ।

এবার ফেসবুকে নির্দিষ্ট সময়ে এসব শিশুদের জামা কেনার জন্য কে কে সহায়তা করবেন, কে কে দোকানের মালিক হবেন তা জানতে চাওয়া হয়। কেউ ১০০ টাকা, কেউ ৫০০ টাকা, আবার কেউ জামা কিনে সরাসরি হাজির হন স্বপ্নের দোকানে। সহায়তার টাকা পাওয়া যায় বিকাশের মাধ্যমে। নির্দিষ্ট দিনে বসে দোকান। চট্টগ্রাম শাখায় এসব শিশুদের জামা কেনার জন্য সহায়তা পাওয়া যায় ৫০ হাজার টাকা। এভাবে বিভিন্ন শাখায় কত টাকা পাওয়া গেল তা আবার ফেসবুকেই জানিয়ে দেওয়া হয়।

আজকের মিরপুরের স্বপ্নের দোকানে হঠাৎ করেই মেয়েকে নিয়ে হাজির হন বাংলাদেশ ওয়ানডে ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। তিনি গাড়ি থেকে না নামলেও তাঁর মেয়ে দোকানে বসে অন্য শিশুদের হাতে জামা তুলে দেয় বলে জানালেন স্বপ্নের দোকানের আয়োজকেরা।

নাঈম অঙ্কন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে বলেন, সরাসরি টাকা-পয়সার লেনদেন নেই, সে ধরনের কাজ করার পরিকল্পনা আছে। এই শিশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর পরিকল্পনা শিগগিরই বাস্তবায়ন করা হবে।

নাঈম অঙ্কন বলেন, তাঁর মা, চাচিসহ অন্যরা সরাসরি ফুটপাতে কাপড় বিছিয়ে দোকানদারি করেছেন কয়েক ঘণ্টা। একটি পোশাকশিল্প কারখানায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত বাবা একেএম রাশিদুজ্জামান বা পরিবারের অন্যরাও এতে সহায়তা করেছেন।