গুঁড়া দুধভর্তি একটি কনটেইনারের গল্প

শিশুদের ভাগ্যে জোটেনি দুধ। আমদানিকারকও পায়নি কিছুই। বন্দর ও কাস্টম হাউসের হিসাবের খাতাও শূন্য। কনটেইনারের মালিকের ভাড়াও রয়ে গেল অনাদায়ি। ব্যাংক পেল না ঋণের টাকা। এই না পাওয়ার কাহিনি চট্টগ্রাম বন্দরে ২৪ বছর ধরে পড়ে থাকা গুঁড়া দুধভর্তি একটি কনটেইনারের।

কনটেইনারটির পরিচিতি নম্বর এসসিএক্সইউ-৪৫৪৯৯১-৯। ‘এমভি হ্যালি’ জাহাজ থেকে ১৯৮৯ সালে নামানো হয়েছিল এই কনটেইনার। সে বছর ৪৯২টি জাহাজ থেকে ৫১ হাজার ৯৫৯ একক কনটেইনার নেমেছিল। সবই বন্দর ছেড়ে গেছে বহু আগে। শুধু নড়েনি এই কনটেইনার।

কে আমদানি করেছিল তার কোনো হদিস এখন আর নেই। কোনো নাম-ঠিকানাই নেই। বন্দরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, বিষয়টি এত পুরোনো যে, এর নথিপত্র সংগ্রহ করা যায়নি। আমদানিপণ্যের মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় থাকারও কথা নয়। এ ছাড়া মামলা বা গুরুত্বপূর্ণ কারণ জড়িত না থাকলে পাঁচ বছর পর সরকারি দলিলপত্র ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

গুঁড়া দুধভর্তি কনটেইনারটি এসেছিল অস্ট্রেলিয়া থেকে। গুঁড়া দুধ প্রস্তুতের পর মেয়াদ থাকে দুই বছর। মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার আগেই কনটেইনারটি নিলামে তুলেছিল কাস্টম হাউস। সেটিও ১৯৯০ সালে। প্রত্যাশিত দর না পাওয়ায় শিশুদের মুখে ওঠেনি সেই গুঁড়া দুধ। এর পরই মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ফলে নিলামেও তোলা হয়নি আর। অথচ সেই গুঁড়া দুধ খালাস হলে মেটাতে পারত ২৮ হাজার শিশুর এক মাসের পুষ্টি।

সরকারের আয়-ব্যয়ের চিত্র আরও ভয়াবহ। আমদানিকারক পণ্য খালাস না করায় কাস্টম হাউসের কোষাগারে জমা হয়নি কোনো টাকা। শেষ চেষ্টা ছিল নিলামে তুলে দুধ বিক্রি করে শুল্ককরের টাকা আদায়। কিন্তু নিলামে বিক্রি না হওয়ায় তা-ও পায়নি কাস্টম হাউস। কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার মাহমুদুল হাসান বললেন, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য থেকে কিছুই আর পাওয়ার নেই।

ধ্বংসযোগ্য পণ্য ধ্বংস করার জন্য রাজস্ব বোর্ডের একটি জাতীয় কমিটি রয়েছে। বর্তমানে এই কমিটির আহ্বায়ক চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার নেয়াজুর রহমান। গুঁড়া দুধভর্তি কনটেইনারটি কেন ধ্বংস করা হয়নি, জানতে চাইলে নেয়াজুর রহমান গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি পণ্য ধ্বংসকরণ একটি জটিল প্রক্রিয়া। কারণ, কোনো পণ্য ধ্বংস করতে হলে বন্দর, বিজিবি, কোস্টগার্ড, জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, কনটেইনারের মালিকপক্ষ, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ অনেকগুলো সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে আলাদা একটি কমিটি করতে হয়। জায়গা নির্বাচন করতে হয়। এখন আমরা গুটি কয়েক লোকবল দিয়ে খালাস না নেওয়া পণ্য বিক্রির জন্য প্রতি মাসে দুটি নিলাম আয়োজন করছি। শিপিং এজেন্টরাও বন্দর থেকে পণ্য ধ্বংসকরণের জন্য ছাড়পত্র আনেনি। এ অবস্থায় নতুন করে পণ্য ধ্বংস করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

এই উদ্যোগ নিতে না পারার মাশুলও দিয়েছে বন্দর। কনটেইনারটি গত ২৪ বছর যে জায়গা দখল করেছে বন্দরের হিসাবে সেই জায়গার ভাড়া এসেছে সোয়া তিন কোটি টাকা। সোয়া তিন কোটি টাকা থেকে কানাকড়িও আর পাবে না বন্দর। এতেও বন্দরের ক্ষতির হিসাব শেষ হয়নি। কনটেইনারটি থেকে প্রতিদিন ৪৮ ডলার ভাড়া হারাচ্ছে বন্দর। ঘণ্টায় দুই ডলার করে। ক্ষতির এই হিসাবটি জানান বন্দরের সচিব সৈয়দ ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ।

প্রায় ৩২০ বর্গফুট জায়গা দখল করে গুঁড়া দুধের কনটেইনারটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও পড়ে আছে বন্দরে।