বিএনপির ভারতবিরোধী নীতি বদলের ছিটেফোঁটা প্রমাণও দিল্লির কাছে নেই

সম্প্রতি ভারত সফর করেন বিএনপির তিন নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু ও হুমায়ুন কবীর। ছবি: সংগৃহীত
সম্প্রতি ভারত সফর করেন বিএনপির তিন নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু ও হুমায়ুন কবীর। ছবি: সংগৃহীত

বিএনপির মনোভাব বদলাচ্ছে কি না, ভারত এখনো সে বিষয়ে নিশ্চিত নয়। কারণ, মনোভাব বদলানোর কোনো ‘বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ’ এখনো ভারতের কাছে নেই। বিএনপির তিন নেতার সাম্প্রতিক ভারত সফরের পর এটাই হলো ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনোভাব। যদিও মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এখন পর্যন্ত জানানো হয়নি।

বাংলাদেশের এই বিরোধী দলটির তিন নেতা স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু এবং আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির সম্প্রতি দিল্লি এসেছিলেন। ভারতের ‘থিংক ট্যাংক’ বলে পরিচিত কয়েকটি সংগঠনের কর্তাদের সঙ্গে তাঁরা কথা বলেন। এই সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজীব গান্ধী ফাউন্ডেশন (আরজিএফ), অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওআরএফ), বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন (ভিআইএফ) ও ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ (আইডিএসএ)। একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি সংবাদপত্রকে তাঁরা সাক্ষাৎকারও দেন। সংবাদে প্রকাশ, বিএনপি নেতারা সবাইকে বোঝাতে চেয়েছেন, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন থাকার সময়ে ভারত সম্পর্কে বিএনপির মনোভাব যা ছিল, তা অতীত। ভারতবিরোধিতার যে সুর তাঁদের মধ্যে ছিল, তা ছিল ‘ভুল ও বোকামি’। অতীতের সেই ভুল শুধরে তাঁরা নতুনভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চান, যার ভিত্তি হবে ‘পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা’। তাঁরা বিভিন্নভাবে সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, তারেক রহমানের নির্দেশেই তাঁদের ভারতে আসা। তারেক চান ১৯৮০ ও ’৯০–এর দশককে পেছনে ফেলে নতুন ‘দৃষ্টিভঙ্গি’ নিয়ে নতুনভাবে সম্পর্ক স্থাপন করতে। তাঁরা চান, ভারত নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সমর্থন করুক, কোনো একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলকে নয়।

বিএনপি নেতাদের এই সফর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং কূটনীতিকদের দৃষ্টি এড়ায়নি। ভারত ও বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোয় এই সফর নিয়ে যে লেখাজোকা বের হচ্ছে, নজর রয়েছে সেসবের ওপরেও। কিন্তু আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করতে মন্ত্রণালয় রাজি নয়। যদিও মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র বলেছে, সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরগুলোর ভিত্তিতে বলা যায়, কয়েকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন প্রথমত, এই সফর প্রধানত তারেক রহমানের উদ্যোগে। দ্বিতীয়ত, তিনি বলেছেন, আগের ‘বিদ্বেষপূর্ণ’ মনোভাবের নীতি নাকি ছিল ‘বিপথ চালিত ও ভুল সিদ্ধান্ত’। এর মধ্য দিয়ে তারেক তাঁর মা খালেদা জিয়ার নীতিরই বিরোধিতা করলেন! তৃতীয়ত, বিএনপি যে সত্যি সত্যিই মনোভাব বদলাতে আগ্রহী, তার কোনো প্রমাণ দলটি এখনো রাখতে পারেনি। চতুর্থত, জামায়াতদের সঙ্গ তারা ছাড়ছে কি না, সে কথাও সফররত নেতারা স্পষ্ট করে জানাননি। ভোটের আগে ও পরে তাদের জামায়াত-সঙ্গর চরিত্র কী হবে, তাও অজানা। ওই সূত্র বলে, ‘সবচেয়ে বড় কথা, পুডিংয়ের স্বাদটা কী রকম, তা না খেলে কখনোই বোঝা যায় না। বিএনপি নেতারা যে কথা বলে গেছেন, তার বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ পাওয়াই বড় কথা। এখনো সেই প্রমাণের ছিটেফোঁটাও ভারতের কাছে নেই।’

ভারতের যাঁরা প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের ভালোমন্দের খবর রাখেন, বিএনপি নেতাদের এই সফর ও দাবি তাঁদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরাও মনে করেন, ভারতের বিশ্বাসযোগ্যতা আদায় করতে হলে দল হিসেবে বিএনপিকে এখনো অনেক পথ হাঁটতে হবে। কারণ, তাদের শাসনকালে ভারতের অভিজ্ঞতা আদৌ সুখকর নয়। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি আজ বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের আজকের যা সম্পর্ক, তা হুট করে গড়ে ওঠেনি। এই সম্পর্কের একটা ধারাবাহিকতা আছে। ইতিহাস আছে। পারস্পরিক নির্ভরতা আছে। দৃষ্টিভঙ্গির সাযুজ্য আছে। আওয়ামী লীগের আমলে ভারত ও বাংলাদেশ সবদিক দিয়ে এগিয়ে চলেছে। বিএনপির সময়ে, দুঃখের কথা, এই নির্ভরতা বা ধারাবাহিকতা অথবা বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল না।’ বীণা সিক্রি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের ভোট করবেন সে দেশের মানুষ। অন্য কোনো দেশের ভোটে ভারতের কোনো ভূমিকা কোনো দিন ছিল না, ভবিষ্যতেও থাকবে না।’

বাংলাদেশে নিযুক্ত আরেক সাবেক হাইকমিশনার দেব মুখোপাধ্যায়ও এই সফরসংক্রান্ত প্রকাশিত সংবাদ আগ্রহ নিয়ে পড়েছেন। তিনি বিস্মিত, সফরকারী নেতারা তারেক রহমানের নাম করে তাঁদের মনোবাসনার কথা জানানোয়। আজ প্রথম আলোকে দেব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘ওঁরা ৮০ ও ৯০ দশকের ভুল শুধরে সরে আসতে চাইছেন ভালো কথা, কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, ২০০১ সালের ভোটের আগে তারেক রহমান নিজে ঠিক এই ধরনের কথাই বলেছিলেন। ঠিক এইভাবে ভারতকে আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাস জানে, ক্ষমতায় এসে তাঁর দল কোন ভূমিকা নিয়েছিল। ভারতকে তারা বোকা বানিয়ে দিয়েছিল।’ বীণা সিক্রির মতো দেব মুখোপাধ্যায়ও বলেন, ‘ভারত গণতন্ত্রের বাহক। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষই সে দেশের নির্বাচনে অংশ নেন। ভোট তাঁরাই দেন। সেখানে ভারতের কিছুই করণীয় নেই। ভোট সুষ্ঠু হোক। সবার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে হোক—এটাই কাম্য।’

বিএনপির তিন নেতার ওই সফর দলীয় অনুমোদন নিয়ে কি না, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সে বিষয়েও নিশ্চিন্ত নয়। কারণ, প্রকাশিত খবরে মন্ত্রণালয় জেনেছে, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের কেউ কেউ ওই সফর নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র জানায়, ওই দলেরই এক নেতা সংবাদপত্রকে বলেছেন, দলের পক্ষ থেকে কাউকে ভারত সফরে পাঠানো হয়েছে বলে তিনি শোনেননি। তিন বড় নেতা ভারতে আসছেন অথচ দল জানে না, এ হতে পারে না। বোঝাই যাচ্ছে, ওই দলে নানা গোষ্ঠী রয়েছে। ভারত সম্পর্কেও রয়েছে নানান অভিমত।

মোট কথা, নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়ার আগে পর্যন্ত বিএনপি সম্পর্কে ভারতের মনোভাব পরিবর্তনের কোনো কারণ এখনো নেই। নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয় কি না, নিলেও তারা জামায়াত-সঙ্গ ত্যাগ করছে কি না, ধর্মীয় মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে তাদের ভূমিকা কী, ভারত এসব দিক নজরে রাখছে।