ফটোগ্রাফির জন্য চাকরিকে গুডবাই

নাঈমা পারভীনের ক্যামেরায় ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা
নাঈমা পারভীনের ক্যামেরায় ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা

মানুষ চেষ্টা করলে কী না পারে! চেষ্টাটা আসতে হয় মনের গহিন থেকে। শেখার যেমন কোনো বয়স নেই, তেমনই শখেরও কোনো জেন্ডার নেই।

এক নারীর গল্প শোনাব, যিনি পাহাড় ডিঙোতে পারেননি, কিংবা সাঁতরে পাড়ি দেননি সাগর। মহাকাশেও যাননি, চন্দ্র বিজয়ও করেননি।

তিনি একজন সাধারণ কর্মজীবী নারী থেকে শৌখিন আলোকচিত্রী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন। ক্যামেরা তিনি হাতে নিয়েছেন ৪৬ বছর বয়সে। এরই মধ্যে পেয়েছেন বেশ কিছু পুরস্কার ও স্বীকৃতি।

নাঈমা পারভীন। নিজেকে বলেন ‘খুলনার মেয়ে’। জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা—সবই খুলনায়। এখন বসবাস করেন চট্টগ্রাম শহরে।

খুলনায় সরকারি ব্যাংকে চাকরি করতেন। ৯টা-৫টা অফিস। ভাইবোন, আত্মীয়-পরিজনে ভরা চারপাশ। এর মধ্যে একদিন স্বামীর বদলির আদেশ এল। নতুন ঠিকানা চট্টগ্রাম। একটিমাত্র মেয়ে, পড়ে খুলনার করনেশন স্কুলে। মেয়ের এ অবস্থায় খুলনা ছাড়ার উপায় নেই। অবশেষে দুই বছর পরে বাক্স-পেটরা গুটিয়ে সংসার পাততে হলো বীর চট্টলা শহরে।

দুরন্ত শৈশব
দুরন্ত শৈশব

স্বামীর চাকরি, নিজেরও চাকরি। নতুন পরিবেশে চাকরি-সংসার মিলিয়ে মন্দ লাগছিল না। আবার তৃপ্ত হতে পারছিলেন না। কী যেন করতে চায় মন। কী যেন বাকি রয়ে গেছে জীবনে! তা ছাড়া খুলনার মতো চেনা মানুষ সেখানে কোথায় পাবেন! তাই গল্পগুজব করে সময় কাটাবেন, সে উপায়ও নেই। সবমিলে একাকিত্বের পোকা মনে বাসা বাঁধল।

একদিন দূরসম্পর্কের এক মামার সঙ্গে ব্যাপারটি নিয়ে কথা বললেন। মামা চটজলদি বললেন, ‘তুমি ফটোগ্রাফি করবে? আমার একটা ক্যামেরা আছে। তোমাকে দিতে পারি।’

মামা সত্যি সত্যি একটা এসএলআর ক্যামেরা পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু এত বড় ক্যামেরা দিয়ে কীভাবে ছবি তুলতে হয়, তা জানা ছিল না। প্রশিক্ষণ নিলেন চট্টগ্রামের ফটোব্যাংক গ্যালারির পরিচালক শোয়েব ফারুকীর কাছে। খুঁটিনাটি জানা হলো। ব্যাংকের কাজ শেষ করে ঘরে ফিরেই আবার ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়তেন।

আসলে এভাবে কি ফটোগ্রাফি হয়?

ঝুঁকি
ঝুঁকি

সম্ভবত না। ফটোগ্রাফি করার জন্য দরকার একটি মনের, যে মন বনে-বাদাড়ে গাছপালার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়, ছোট নৌকার গলুইয়ে বসে পাড়ি দেয় ঢেউয়ের নদী, কিংবা মানুষের সুখ-দুঃখ যার মনে বিশেষ অনুভূতির সৃষ্টি করে, সে-ই পারে সারা দিন ‘ইট ভেঙে’ সন্ধ্যায় আবার মনের খাবার খেতে, ঘরের বাইরে যেতে।

এ রকমই একটি মন ছিল বলেই নাঈমা পেরেছেন। কাজটি তো সৃজনশীল।

২০০৬ সাল থেকে পরের পাঁচ বছর চাকরির পাশাপাশি ফটোগ্রাফি করেছেন। ‘তুমি নারী হয়ে কেন এসব করো? কী দরকার এই বয়সে ঢইঢই করে ঘুরে বেড়ানো?’ চারদিক থেকে আসা এসব বাধার তির ঠেকিয়ে দিয়েছেন দুর্নিবার ইচ্ছার ঢাল দিয়ে।

দিনে দিনে চাকরির নেশাটা কমে যায়। বেড়ে যায় ফটোগ্রাফির নেশা। একটা সময় চাকরিটা ছেড়েই দিলেন। এবার শুনতে হলো, ‘তোমার কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে, যে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফটোগ্রাফি করতে চাইছ?’ তবু যেন মুক্তি। ক্যামেরাটা ধরলেন শক্ত হাতে। নিজের ফটোগ্রাফার পরিচয়ে ভীষণ গর্ব হতো।

এক যুগের কাছাকাছি সময় ফটোগ্রাফি করছেন নাঈমা। এর মধ্যে বেশ কিছু পুরস্কার জুটেছে। যেমন দ্য রিডার্স ডাইজেস্ট এশিয়ার ‘আনসিন এশিয়া’ বিভাগে তাঁর ছবি বেরিয়েছে ২০১১ সালের নভেম্বরে। পরের বছর ‘ইমাহ ম্যাগাজিন এক্সিবিশন’-এ ছিল তাঁর ছবি। ২০১৩ সালে ৭৪তম ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফিক স্যালন অব জাপান (আশাহি শিমবুন) প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত হয়েছেন। এর বাইরে অস্ট্রেলিয়া ও জাপানে দুটি স্বীকৃতিসহ দেশে-বিদেশে অন্তত আরও চারটি পুরস্কার পেয়েছেন নাঈমা।

কাজ করতে গিয়ে নিজের ঝুলিতে জমেছে কিছু আনন্দ-বেদনার অভিজ্ঞতাও।

তৃষ্ণার্ত মাঠ ফেটে চৌচির
তৃষ্ণার্ত মাঠ ফেটে চৌচির

২০১২ সালে একবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে গেছেন ছবি তুলতে। হঠাৎ একটা জায়গা থেকে গোলমাল, ঝগড়াঝাঁটির খবর। কাছে গিয়ে জানলেন, এক রোহিঙ্গা যুবক স্ত্রী ও দুই ছেলে থাকা অবস্থায় ১৫ বছর বয়সী আরেকটি রোহিঙ্গা মেয়েকে বিয়ে করেছেন। এখন তাঁর আগের স্ত্রী-সন্তানেরা কান্নাকাটি করছে।

নাঈমা তখন ক্যামেরাটি উঁচু করে ধরে জোর গলায় যুবকটিকে বললেন, ‘তুমি কি জেলের ভাত খেতে চাও? তোমার এই বিয়ে বৈধ নয়। এদের সঙ্গে মিটমাট করে আগের বউয়ের কাছে ফিরে যাও।’ এরপর তাঁর স্ত্রীকে বললেন, ‘সে যদি তোমার কাছে ফিরে না আসে, আমাকে জানাবে।’

ঘটনাটি ভুলে গিয়েছিলেন নাঈমা। হঠাৎ একদিন মেয়েটা ফোন করে চাকরি চায়। নাঈমা জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার স্বামীর কী খবর? সে কি তোমার কাছে ফিরে এসেছে?’ মেয়েটি বলে, ‘সে তো তখনই ফিরে এসেছে।’

সাধারণ কর্মজীবী নারী থেকে শৌখিন আলোকচিত্রী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন নাঈমা পারভীন
সাধারণ কর্মজীবী নারী থেকে শৌখিন আলোকচিত্রী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন নাঈমা পারভীন

নাঈমা বলেন, ‘শুনে ভালো লাগল যে আমার কারণে একটি সংসার টিকে গেল।’

একবার চট্টগ্রাম স্টেশনে ট্রেনে উঠতে যাবেন। ট্রেন ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। এক বয়স্ক ব্যক্তির দিকে হাত বাড়িয়ে দেন। ভদ্রলোক হাত সরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘তুমি জিনস পরে ফটোগ্রাফি করো, আর ট্রেনে উঠতে পারো না?’

নাঈমা বলেন, খুবই বিব্রত লেগেছিল সেদিন। আর যাওয়াও হয়নি।

নারীদের নিয়ে একটা ফটোগ্রাফি সোসাইটি করতে চান নাঈমা। শুরু করেও সংগঠনটি এগিয়ে নিতে পারছেন না।

সব সময় স্বচ্ছতায় বিশ্বাসী নাঈমা। তাঁর ভাষায়, ‘ক্যামেরার সিসিডির মতো মনের সিসিডিটাও পরিষ্কার থাকা দরকার। তাহলে সেখানে ভালো ছবি উঠবে।’