মধুপুরে ১২৫ বছরের মন্দিরের জায়গা দখল করে বাণিজ্যিক ভবন!

টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় ১২৫ বছরের পুরোনো শ্রী শ্রী মদন গোপাল মন্দির ও দেবোত্তর এস্টেটের জায়গা দখল করে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করছে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি। ছবি: প্রথম আলো
টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় ১২৫ বছরের পুরোনো শ্রী শ্রী মদন গোপাল মন্দির ও দেবোত্তর এস্টেটের জায়গা দখল করে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করছে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি। ছবি: প্রথম আলো

টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় ১২৫ বছরের পুরোনো শ্রীশ্রী মদন গোপাল মন্দির ও দেবোত্তর এস্টেটের জায়গা দখল করে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সম্পৃক্ততায় মধুপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি এই বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে মধুপুরের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে।

মন্দির পরিচালনা কমিটির নেতাদের তথ্যমতে, একসময় মধুপুর এলাকা ছিল রাজশাহীর পুঠিয়ার জমিদারদের তালুক। ১৮৯১ সালে পুঠিয়ার মহারানি হেমন্ত কুমারী চৌধুরানী মধুপুর উপজেলা সদরে মদন গোপাল মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরটি পরিচালনা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি ৯ একর ১৭ শতাংশ জমি দান করেন। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পর পাকিস্তান সরকার এই জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেয়। এর বিরুদ্ধে ময়মনসিংহ মুনসেফ আদালতে মামলা হয়। ১৯৬৩ সালের ৩১ নভেম্বর আদালত মদন গোপাল বিগ্রহের পক্ষে রায় দেন। পরে এই রায়ের বিরুদ্ধে সরকারপক্ষ ময়মনসিংহ জেলা জজ আদালতে আপিল করে। শুনানি শেষে ১৯৬৭ সালের ২৯ জুলাই জজ আদালত সরকারপক্ষের আপিল আবেদন খারিজ করে দেয়।

মন্দির কর্তৃপক্ষ জানায়, আদালতের রায় পাওয়ার পর থেকে এই সম্পত্তি তাদের নামেই রয়েছে। তারা নিয়মিত খাজনাও দেয়। বিভিন্ন সময় এই দেবোত্তর সম্পত্তি বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান দখল করেছে। যদিও মন্দিরের নামেই সব জমির রেকর্ড রয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, দখলের সর্বশেষ প্রক্রিয়া শুরু করেছে মধুপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি। এই সমিতির নামে ১৯৬২ সালে ২ শতাংশ জায়গা (২৯৯ দাগের) দেবোত্তর এস্টেট থেকে পত্তন নেওয়া ছিল। গত বছর সমিতি ওই জায়গায় একটি চারতলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। সমিতি গত বছর ৩১ আগস্ট মধুপুর পৌরসভা থেকে নকশা অনুমোদনও নেয়। কিন্তু সমিতি তাদের পত্তন নেওয়া ভূমিতে ভবন নির্মাণকাজ না করে মন্দিরের মালিকানাধীন ভূমিতে (২৪১ দাগের) ভবন নির্মাণকাজ শুরু করেছে।

বিষয়টি মন্দির পরিচালনা কমিটির নজরে আসার পর তারা মধুপুর পৌরসভার মেয়রকে গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর লিখিতভাবে জানায়।

মেয়র সরেজমিন তদন্ত করে মন্দিরের মালিকানাধীন ভূমিতে ভবন নির্মাণকাজ দেখতে পান। পরে তিনি নির্মাণকাজ বন্ধ করতে প্রাথমিক শিক্ষক সমিতিকে লিখিতভাবে নির্দেশ দেন। লিখিত নির্দেশ পাওয়ার পর কিছুদিন বন্ধ রেখে আবার কাজ শুরু করে তারা।

পরে মন্দির পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব জীবন কুমার চৌধুরী গত ২৩ নভেম্বর মধুপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিতভাবে কাজ বন্ধের এবং দেবোত্তর সম্পত্তি উদ্ধার করে বুঝিয়ে দেওয়ার আবেদন জানান। একই সঙ্গে টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ওই জমির ওপর ১৪৪ ধারা জারি এবং শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গের আশঙ্কায় মামলা করেন।

আদালত মধুপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যবস্থা নেওয়ার এবং মধুপুর উপজেলার সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) জমির নকশাসহ দখল প্রতিবেদন দেওয়ার আদেশ দেন। আদেশ পেয়ে উপজেলা প্রশাসন মধুপুর উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ারকে দিয়ে ওই জমি সরেজমিন তদন্ত করান। তদন্ত প্রতিবেদনে সার্ভেয়ার রাজু আহমেদ উল্লেখ করেন, যেখানে প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তা মদন গোপাল মন্দিরের নামে রেকর্ডভুক্ত। ওই জমির উন্নয়ন কর মদন গোপাল মন্দিরের সেবাইতদের পক্ষে সদস্যসচিব জীবন কুমার চৌধুরী পরিশোধ করেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের মধুপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে উত্তর দিকে কিছুটা পথ এগিয়ে গেলেই মদন গোপাল মন্দিরের সেই সম্পত্তি। সেখানে পুরোদমে নির্মাণকাজ চলছে।

এ ব্যাপারে মধুপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মফিজ উদ্দিন জানান, পৌরসভা কাজ বন্ধের নির্দেশ দিলেও স্থানীয় লোকজন সমঝোতা করে দিয়েছে। তাই নির্মাণকাজ চালানো হচ্ছে।

শ্রীশ্রী মদন গোপাল দেবোত্তর এস্টেট ও মন্দির পরিচালনা পরিষদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা জানান, শিক্ষক সমিতির পেছনে উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা রয়েছেন। নির্মাণাধীন এই ভবন থেকে তাঁরাও লাভবান হবেন। তাই নেতারা শিক্ষক সমিতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে মধুপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খন্দকার শফিউদ্দিন মণির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, অনেক বছর ধরে ওই স্থানে শিক্ষক সমিতির একটি অফিস ছিল। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা কেউ কোনো দখল প্রক্রিয়ায় জড়িত নন। শান্তিপূর্ণ একটি সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছিলেন নেতারা। কিছু লোক রাজনৈতিক নেতাদের নামে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

মধুপুর পৌরসভার মেয়র মাসুদ পারভেজ বলেন, যে স্থানে প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, ওই জায়গা মদন গোপাল মন্দিরের। কাজ বন্ধের জন্য শিক্ষক সমিতিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এরপরও তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।