আ.লীগের উন্নয়নের প্রচার, বিএনপির মাঠে থাকার লড়াই

বিএনপি জিতলে নগরের উন্নয়ন হবে না—এই প্রচার সামনে নিয়েই তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মাঠে নেমেছে আওয়ামী লীগ। খুলনা ও গাজীপুরে এই প্রচার কাজে দিয়েছে বলে মনে করছে দলটি। তবে বিএনপি মনে করছে, খুলনা ও গাজীপুরে সরকারি প্রশাসন ব্যবহার করে বিএনপিকে মাঠছাড়া করা হয়েছে। রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেটেও একই ভয় তাদের মধ্যে প্রবল। এ জন্য খুলনা ও গাজীপুরের পরিস্থিতি এড়াতে এজেন্ট বাছাই ও ভোটকেন্দ্র পাহারায় নতুন কৌশলের খোঁজে আছে বিএনপি।

আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু না হলেও এরই মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থীরা নানা কায়দায় মাঠে নেমে পড়েছেন। তাঁরা শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়ে, সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে, পেশাজীবী সংগঠন ও দলীয় নানা ফোরামের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন। তবে নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের মধ্যে এখনো খুব একটা উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে না।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মেয়র পদে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। রাজশাহী ও সিলেটে দুই দলের চারজন সাবেক ও সদ্য সাবেক মেয়র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বরিশালেও দুই দলের প্রার্থীরা প্রভাবশালী। ফলে জয় দেখছে দুই দলই। ভোটারদেরও ধারণা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে প্রধান দুই দলের মধ্যেই।

৩০ জুলাই রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশনে ভোট গ্রহণ করার দিন ধার্য করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ৯ জুলাই প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। প্রতীক বরাদ্দ ১০ জুলাই, এরপর থেকেই আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু করতে পারবেন প্রার্থীরা।

২০১৩ সালের জুনে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেটে একযোগে ভোট হয়। চারটিতেই বিএনপির প্রার্থীরা জয়ী হন। এরপর জুলাইতে অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিএনপির প্রার্থীর কাছে হেরে যান। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত এই পাঁচ সিটির ভোটে জয়কে নিজেদের জনপ্রিয়তা হিসেবে দেখায় বিএনপি। যদিও দলটি জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে।

এবারও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি ভোটের জন্য প্রস্তুত হয়। সরকার চাইলে একযোগেই সব সিটিতে ভোট করতে পারত। তবে এবার ভোট হচ্ছে ভেঙে ভেঙে। প্রথমে ১৫ মে গাজীপুর ও খুলনার ভোটের দিন নির্ধারণ করা হয়। আইনি জটিলতায় গাজীপুরে ভোট আটকে গেলে ২৬ জুন ভোট গ্রহণ হয়।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, একসঙ্গে অনেকগুলো সিটিতে ভোট হলে সরকারি দলে থাকার যে সুবিধা, এর পূর্ণাঙ্গ সদ্ব্যবহার করা যায় না। এ জন্যই এবার একসঙ্গে অনেকগুলো সিটি করপোরেশনে ভোট চায়নি আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, খুলনা ও গাজীপুরে প্রশাসনের চাপে বিএনপি মাঠছাড়া হয়ে গেছে। ফলে অনায়াসে জয় পেয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। এই কৌশল থেকে আসন্ন তিন সিটির ভোটেও বিএনপিকে সংঘবদ্ধ শক্তি হিসেবে মাঠ দখলের সুযোগ দেওয়া হবে না। তবে কৌশলে কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। তিন সিটিতে জয় ছাড়া কিছু ভাবছে না আওয়ামী লীগ।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ফারুক খান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বায়বীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। তারা উন্নয়নের গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। মানুষ বুঝে গেছে, উন্নয়ন করার সক্ষমতা আওয়ামী লীগেরই আছে। খুলনা ও গাজীপুরে তা প্রমাণিত। আসন্ন তিন সিটিতেও তা-ই হবে।

অন্যদিকে রাজশাহী বিএনপি বলছে, তারা খুলনা ও গাজীপুরের মতো হতে দেবে না। ভোটের দুই দিন আগেই এজেন্টদের পরিচয় উন্মুক্ত করে দেবে। প্রয়োজনে এজেন্টদের পরিচয় নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের কাছেও দেওয়া হবে। তবে পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার ও নতুন করে মামলা দেওয়ার আতঙ্ক আছে তারা। সিলেটে বিশ্বস্ত ও সাহসী এজেন্ট খোঁজা হচ্ছে বলে বিএনপির নেতারা জানিয়েছেন। বরিশাল বিএনপির নেতারা বলছেন, সিটি নির্বাচনের পর বর্তমান সরকারের মেয়াদ থাকবে দুই থেকে আড়াই মাস। এটাই ভোটার ও দলের নেতাদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন তাঁরা। যাতে কেন্দ্রে শক্তি ধরে রাখেন। বিএনপির ধারণা, নেতা-কর্মীরা মাঠে থাকতে পারলে এবং ভোটাররা ভোট দিতে পারলে তিন সিটিতেই তাদের জয় হবে।

সিলেট-রাজশাহীতে চার মেয়রের লড়াই

রাজশাহী ও সিলেটে অনানুষ্ঠানিকভাবে এক বছর আগেই মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ঠিক করে রাখা হয়েছে। রাজশাহীর সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, সিলেটের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা তা জানিয়েও দেন। এই দুই সাবেক মেয়র নিজ নিজ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য। সিলেটে একাধিক প্রার্থী আগ্রহ দেখালেও রাজশাহীতে অন্য কেউ চেষ্টাও করেননি। ক্ষমতাসীন দলের নেতা, সাংগঠনিকভাবে দায়িত্বশীল পদে থাকা এবং আগে থেকেই দলীয় মনোনয়নের সবুজ সংকেতের প্রভাব প্রচারেও পড়েছে। বিএনপির চেয়ে অনেক আগেই অনানুষ্ঠানিক প্রচার শুরু করেছেন এই দুই প্রার্থী।

অন্যদিকে বিএনপি এই দুই সিটিতে দলের দুই সদ্য সাবেক মেয়রকেই প্রার্থী করেছে। সিলেটে আরিফুল হক ও রাজশাহীতে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। এই দুজনও নিজ দলের মহানগর সভাপতি, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। এই দুজনের আরও মিল হলো, তাঁরা মেয়র হয়ে স্বস্তিতে কাটাতে পারেননি, কারাগারে বন্দী ও আদালতের বারান্দায় দৌড়াতে হয়েছে বড় একটা সময়।

বিরোধী দলের প্রার্থী মেয়র হওয়ার কারণে নগরের মানুষ উন্নয়নবঞ্চিত হয়েছে—এই প্রচার চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে রাজশাহীতে তা বেশ জোরালো। কারণ, খায়রুজ্জামান রাজশাহীর মেয়র থাকা অবস্থায় চোখে পড়ার মতো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। আর বদরউদ্দিন কামরান সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভা মিলে সিলেট নগরের দায়িত্বে ছিলেন টানা ১৮ বছর।

সিলেট সদর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নিজের নির্বাচনী এলাকা বলে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। আর অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে মেয়রের একটা কর্ম সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। ফলে আরিফুল হক এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে নিজের অবস্থান শক্ত করতে পেরেছেন। তবে গলার কাঁটা হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর সিলেট মহানগর আমির এহসানুল মাহবুব জুবায়ের প্রার্থী হিসেবে আছেন। মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিমও বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। অবশ্য এখনো তাঁদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় আছে।

ভোটার এবং দুই প্রধান দলের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনে করছেন, এই দুই সিটির মূল চার প্রার্থীরই সাংগঠনিক অবস্থান শক্তিশালী। পরিচিতিও আছে বেশ। ফলে সাবেক ও সদ্য সাবেক চার মেয়রের জমজমাট লড়াই হবে রাজশাহী আর সিলেটে।

বরিশালে অভিজ্ঞ বনাম নবীন

বরিশালে বিএনপির অবস্থান বরাবরই শক্ত। দলটির মেয়র প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে কখনোই হারেননি। বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র তিনি। তিনি সদর আসন থেকে তিনবার সাংসদ হয়েছেন। দলের মহানগর সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিবও। যেকোনো বিবেচনায় সরোয়ার শক্ত প্রার্থী। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সন্তান। পুরো বরিশাল বিভাগের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তাঁর বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর প্রভাব রয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রচারের কেন্দ্রে আছে উন্নয়ন। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়ী হলে উন্নয়ন হবে—এটাই বোঝাতে চাইছে সরকারি দল। প্রয়াত শওকত হোসেন হিরণ মেয়র থাকা অবস্থায় প্রচুর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। সদ্য সাবেক মেয়র বিএনপির আহসান হাবিব কামাল নগরের উন্নয়ন করতে পারেননি—এই বাস্তবতা আওয়ামী লীগের প্রচারে জোর হাওয়া দিচ্ছে।

বরিশাল সিটিতে ভোটার ২ লাখ ৪২ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ৩১ হাজার নতুন ভোটার। আওয়ামী লীগ নবীন প্রার্থী দিয়ে এই নতুন ভোটারদের পক্ষে টানার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে সাংগঠনিক দক্ষতা আর অতীতে নির্বাচনী রাজনীতির অভিজ্ঞতা নিয়ে মাঠে আছেন বিএনপির প্রার্থী। সবাই বলছে, নবীন আর প্রবীণ প্রার্থীর মধ্যেই শক্ত লড়াই হবে।

এর বাইরে সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত সব কটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনেই ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীরা একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভোট পেয়েছে। কিছু স্থানে তাদের অবস্থান আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরই। বরিশালে তাদের প্রার্থী ওবায়দুর রহমান। বরিশালেরই চরমোনাই পীর এই দলটির প্রতিষ্ঠাতা। ফলে সিটি নির্বাচনে তাদের একটা প্রভাব থাকবে বলেই মনে করছেন ভোটাররা। ২০০৮ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২৭ হাজারের বেশি ভোট পেয়ে তারা তৃতীয় অবস্থানে ছিল।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, খুলনা ও গাজীপুরের নির্বাচনের কয়েকটি বৈশিষ্ট দেখা গেছে। এগুলো হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবহার করে বিরোধীদের মাঠছাড়া করা, বিএনপির পোলিং এজেন্ট বের করে দেওয়া, ভোট কেন্দ্রে জবরদস্তি, আওয়ামী লীগ না জিতলে উন্নয়ন হবে না—এই প্রচার এবং নির্বাচন কমিশনের নির্বিকার ভূমিকা। কমিশন নিজের ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করলে সরকারি দল অন্য সুবিধাগুলো নিতে পারত না। তাই আসন্ন তিন সিটি নির্বাচন কেমন হবে, তা নির্ভর করছে কমিশনের ভূমিকার ওপর।