বর্ণে ছন্দে সুরে আনন্দের একদিন

রাজধানীর ধানমন্ডির সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স মাঠে গতকাল শিশু-কিশোরদের নিয়ে বেলুন উড়িয়ে বর্ণমেলার উদ্বোধন করেন অতিথিরা । ছবি: সাহাদাত পারভেজ
রাজধানীর ধানমন্ডির সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স মাঠে গতকাল শিশু-কিশোরদের নিয়ে বেলুন উড়িয়ে বর্ণমেলার উদ্বোধন করেন অতিথিরা । ছবি: সাহাদাত পারভেজ

বিশাল আকারের এক ধবধবে সাদা বোর্ড পেতে রাখা মাঠের মাঝখানে। ছবি আঁকা হচ্ছে তার ওপর। রং-তুলি নিয়ে চারপাশ থেকে বোর্ডটিকে ঘিরে আছে শিল্পীরা। মনের মাধুরী মিশিয়ে রঙের প্রলেপ দিচ্ছে কেউ; কেউ মনোযোগী রেখা টেনে মাছ, ফুল, লতা-পাতা আঁকতে। কিন্তু তাতেও সুবিধা হচ্ছিল না কারও কারও। বোর্ডটি যেমন লম্বা, তেমনি চওড়াও। অগত্যা কেউ কেউ উঠে পড়ল বোর্ডের ওপর।
গতকাল শুক্রবার মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে প্রথম আলো আয়োজিত বর্ণমেলায় খুদে আঁকিয়েদের অঙ্কনে মগ্নতার এই দৃশ্য দেখা গেল ধানমন্ডির সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স মাঠে। এবার পঞ্চমবারের মতো বর্ণমেলার আয়োজন করল প্রথম আলো। ঢাকা ও চট্টগ্রামে একই সঙ্গে হলো দিনভর বর্ণমেলার আনন্দঘন আয়োজন। সম্প্রচার সহযোগী হিসেবে চ্যানেল নাইন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বর্ণমেলার সারা দিনের কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার করেছে। বর্ণমেলার বিশেষ সহযোগিতায় ছিল সার্ফ এক্সেল। সহযোগিতা করেছে পেপসোডেন্ট, লাইফবয়, পিউরিট, মেরিল বেবি ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। আরেক সম্প্রচার সহযোগী ছিল এবিসি রেডিও।
আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সময় ছিল সকাল নয়টা। এর ঘণ্টা খানেক আগেই শিশু-কিশোর আর অভিভাবকদের উপস্থিতিতে মাঠটি প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে। বর্ণমালাখচিত বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক। পাশে ছিলেন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার ও প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক। আহমদ রফিক নবীন প্রজন্মের উদ্দেশে বলেন, মায়ের ভাষা বলে বাংলাকে অবহেলা করলে চলবে না। এই ভাষা শুদ্ধ করে বলতে, লিখতে, শিখতে হবে। সমাগত জনদের স্বাগত জানান প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ। এর আগে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন সুরের ধারার শিল্পীরা।
উদ্বোধনী পর্ব শেষে বিরামহীন অনুষ্ঠান—ছবি আঁকা, হাতেখড়ি নেওয়া, সুন্দর করে লেখা আর স্টলে স্টলে ঘুরে বেড়ানো। সেই স্টলগুলোও ছিল বড় মজার। সব বর্ণমালা দিয়ে নাম। ‘বর্ণভোজ’-এ অক্ষর দিয়ে তৈরি পিঠাপুলি। ‘বর্ণমুখোশ’-এ পাওয়া যাচ্ছিল অক্ষর দিয়ে বানানো রংবেরঙের মুখোশ। টি-শার্টে নকশা করার স্টলটির নাম ‘বর্ণায়ন’। নাগরদোলা হয়েছে ‘বর্ণদোলা’, হরেক রকম উপকরণ দিয়ে তৈরি অক্ষরের প্রদর্শনীর নাম ‘বর্ণপ্রদর্শনী’—এমন। আর মঞ্চটির নাম ‘বর্ণমঞ্চ’। সেই মঞ্চে সুরের ধারার শিল্পীদের গানের পরে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে ছোট্ট একটি নাটক পরিবেশন করল মাধুয়াই। সেই নাটকের এক ফাঁকে দেখা গেল মঞ্চে এলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম আর বেগম রোকেয়ার সাজে তিনজন। মিতা হক গেয়ে শোনালেন ‘আজি বাংলাদেশের হূদয় হতে’ ও ‘নাই নাই ভয়’। শেয়াল পণ্ডিতের গল্প শোনালেন তামান্না তিথি।
এর পরই মঞ্চের সামনে উপচে পড়া ভিড়। কারণ, তখন মঞ্চে হাজির সিসিমপুরের বন্ধুরা। টুকটুকি, হালুম, ইকরি। ‘রক্ত শিমুল তপ্ত পলাশ দিল ডাক’ গেয়ে শোনালেন জাগরণের শিল্পীরা। বেশ কয়েকটি গান শোনালেন তাঁরা।
ওদিকে তখন মাঠের এক পাশে চলছে হাতেখড়ি, অন্য পাশে ছবি আঁকা আর সুন্দর হাতের লেখার প্রতিযোগিতা। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর নেতৃত্বে শিশুদের হাতেখড়ি দেন শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী, সৈয়দ আবুল বারক আলভী, আবদুল মান্নান, নিসার হোসেন, আফজাল হোসেন, শিশির ভট্টাচার্য্যসহ অনেকে। মঞ্চে তখন শিশুদের নিয়ে ছড়া পড়ছিলেন মাহমুদা আক্তার। গানের দল চিরকুটের পরিবেশনা শুরু হয়েছিল ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ দিয়ে। জান্নাত-এ-ফেরদৌসী পরিবেশন করেন ‘ও আমারই বাংলা ভাষা’, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস শোনান ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলি রে বাঙালি’। একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ আবৃত্তি করেন শিমুল মুস্তফা। নৃত্যাঞ্চলের শিল্পীরা পরিবেশন করেন সমবেত নৃত্য।
হঠাৎ মঞ্চে আবির্ভাব ঘটল এক মস্ত সাপের। তার সঙ্গে এল ষাঁড়, কৃষকসহ আরও অনেকে। নাচের সঙ্গে নানা উপদেশ শোনাল তারা। এই পাপেট শোটি পরিবেশন করে মাল্টিমিডিয়া পাপেট থিয়েটার। এরপর আবার গান। মাতিয়ে দিলেন কুমার বিশ্বজিৎ। প্রথমে তিনি দেশি বাদ্যযন্ত্র খঞ্জনির বোলের সঙ্গে সওয়াল-জওয়াব করেন। খঞ্জনি বাজিয়েছেন মিঠুন।
গানে গানে কেটেছে বেলা। ফাহমিদা নবী, বাপ্পা মজুমদার, কনা, মুহিন, সাব্বির, নিশিতা বড়ুয়া, কোনাল, লিজা ও কর্নিয়া গেয়ে শোনান বিভিন্ন ধরনের গান।
বেলা পড়ে এসেছিল। বর্ণ প্রদর্শনী, চিত্রাঙ্কন, সুন্দর হাতের লেখা ও টি-শার্ট বর্ণায়নের পুরস্কার ঘোষণা করতে সঞ্চালক সাইদুজ্জামান মঞ্চে আহ্বান জানালেন শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী, আবদুল মান্নান, অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফকে। এবার একুশে পদক পাওয়ায় শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরীকে অভিনন্দন জানানো হয় করতালি দিয়ে। বেলা তখন গড়িয়ে শেষ বিকেল।
শেষ পরিবেশনার জন্য মঞ্চে এলেন অর্ণব ও তাঁর বন্ধুরা। রবীন্দ্রসংগীত ‘আমি মারের সাগর’ দিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁদের পরিবেশনা। পরে গাইলেন ‘সোনা দিয়া বান্ধাইছি ঘর’, ‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘মাঝি নাও ছাইড়া দে’। গান গেয়ে বিদায় নিয়ে মঞ্চ ছাড়তে গিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু দিনভর এত গান, এত সুরেও তৃষ্ণা মেটেনি শ্রোতাদের। অতএব বিশেষ অনুরোধে গেয়ে শোনালেন, ‘সে যে বসে আছে’। অনুরোধ রেখে শিল্পীরা মঞ্চ ছাড়লেন, কিন্তু দর্শকদের মন যেন ঘরে ফিরতে চাইছিল না। তখনো মাঠের মধ্যে ছোটাছুটিতে ব্যতিব্যস্ত হয়েছিল শিশু-কিশোরের দল। তাদের অভিভাবকেরাও খুব বেশি তাড়া দিচ্ছিলেন না ঘরে ফেরার জন্য। ফলে শেষের পরেও আনন্দের রেশ ছড়িয়ে থাকল ভাঙা মেলার মাঠে।

রঙে রঙে খুদে শিল্পীরা রাঙিয়ে তুলছে বর্ণমেলা মাঠের বিশাল বোডর্, শিশুদের নিয়ে বর্ণ প্রদর্শনীতে অভিভাবকেরা । প্রথম আলো
রঙে রঙে খুদে শিল্পীরা রাঙিয়ে তুলছে বর্ণমেলা মাঠের বিশাল বোডর্, শিশুদের নিয়ে বর্ণ প্রদর্শনীতে অভিভাবকেরা । প্রথম আলো