৯ শিশুর মৃত্যু পাল্টে দিয়েছে ত্রিপুরাপাড়ার জীবনযাত্রা

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের মধ্য সোনাইছড়ির সেই ত্রিপুরাপাড়ায় শিশুদের পড়াশোনার জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে স্কুল। ছবি: কৃষ্ণ চন্দ্র দাস।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের মধ্য সোনাইছড়ির সেই ত্রিপুরাপাড়ায় শিশুদের পড়াশোনার জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে স্কুল। ছবি: কৃষ্ণ চন্দ্র দাস।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে মধ্য সোনাইছড়ি পাহাড়ে ত্রিপুরাপাড়ায় রয়েছে মাত্র ৬৫টি পরিবার। সোনাইছড়ি ইউনিয়নের ছোট্ট এই পাড়ায় যখন একে একে নয় শিশু মারা গেল, সবাই শোকে বিহ্বল। সে বিশাল এক ধাক্কা! শিশুদের মৃত্যুর খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। নড়েচড়ে বসে প্রশাসন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। কর্তাব্যক্তিরা পাড়াটি পরিদর্শন করে দেখতে পান, আধুনিকতার কোনো ছোঁয়ায় যেন লাগেনি সেখানে।

এ ঘটনা ঠিক এক বছর আগের। ত্রিপুরাপাড়ায় হাম রোগে আক্রান্ত হয়ে নয় শিশুর মৃত্যুর এক বছর পূর্তি আজ বৃহস্পতিবার। গত বছরের এই দিনে হাম রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রথমে চার শিশুর মৃত্যু হয়, পরে এক সপ্তাহের মধ্যে মারা যায় আরও পাঁচ শিশু।

শিশুদের মৃত্যু পাল্টে দেয় পাড়াটির জীবনযাত্রা। শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা, স্বাস্থ্য নিয়ে অসচেতন এই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ এই এক বছরে অনেকটাই সচেতন হয়েছে। রোগ হলে ওঝা-বৈদ্যের কাছে ঝাড়ফুঁক করাতে না গিয়ে চিকিৎসাসেবা নেয় সরকারের অস্থায়ী ক্লিনিকে। নিয়মিত টিকা নিচ্ছে শিশু ও নারীরা। যত দূর সম্ভব ছড়ার পানি পান না করে কূপের পানি পান করছে তারা।

স্থানীয় বাসিন্দা বিপন ত্রিপুরার আফসোসের শেষ নেই। তিনি বলেন, ‘সরকারের এসব উন্নয়ন যদি এক বছর আগে হতো, তাহলে আমাদের এই নয় শিশু মারা যেত না। ঝাড়ফুঁক করে একে একে নয়টি শিশু সন্তান হারিয়েছি। আর ঝাড়ফুঁকের প্রশ্নই আসে না।’

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ওই ঘটনার পর প্রশাসন থেকে ত্রিপুরাদের যাতায়াতের ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা সংস্কার, কূপ-নলকূপ স্থাপন, স্কুল, অস্থায়ী ক্লিনিক নির্মাণ ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নির্মাণ করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, একটি করে কূপ, অস্থায়ী ক্লিনিক, টিকাকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে পাড়াটিতে। স্কুল নির্মাণের কাজ চলছে। তিন কক্ষের আধা পাকা স্কুলঘরটির টিনের ছাদ নির্মাণে কাজ করছেন দুজন মিস্ত্রি। পাড়ায় কূপ থেকে জল তুলছেন নারীরা। তবে চলাচলের রাস্তাটি প্রশস্ত করা হলেও কাঁচা রয়ে গেছে।

স্কুলঘর নির্মাণকাজের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ ইউনুছ বলেন, স্কুলের ঘরটি বুঝিয়ে দিতে আরও ১৫ দিন সময় লাগবে। স্কুলের পাশে একটি শৌচাগার, গভীর নলকূপ হবে।

সেখানকার বাসিন্দা কাঞ্চন ত্রিপুরা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের প্রতিশ্রুতি ধীরে হলেও বাস্তবায়ন দৃশ্যমান হচ্ছে। তবে মূল সমস্যা হলো—আমাদের স্থায়ী ভূমি নেই। যাদের জায়গায় থাকি, তারা তুলে দিলে এ উন্নয়ন আমাদের কোনো কাজে লাগবে না। এ ছাড়া ক্লিনিকটি স্থায়ীভাবে স্থাপন করতে হবে।’ সে জন্য ত্রিপুরাদের জন্য খাসজমি স্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

এ ব্যাপারে সীতাকুণ্ডের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তারিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উন্নয়ন প্রকল্প নামে একটি প্রকল্পের আওতায় ওই ত্রিপুরাপাড়ার রাস্তা নির্মাণ বাবদ তিন লাখ টাকা, তিন কক্ষের স্কুল ভবন নির্মাণে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা, নলকূপে ৫০ হাজার টাকা, প্রাক্‌-প্রাথমিকের দুজন শিক্ষকের দুই বছরের বেতন বাবদ দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। স্কুল নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা, নলকূপসহ আরও প্রয়োজনীয় উন্নয়নের জন্য ২৭ লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়ে একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’

স্থায়ী ভূমি বরাদ্দের ব্যাপারে ইউএনও বলেন, ত্রিপুরা বাসিন্দারা আবেদন জানালে ওই এলাকায় খাসজমি খুঁজে তাদের বরাদ্দ দেওয়ার জন্য সুপারিশ পাঠাবেন।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ত্রিপুরা বাসিন্দারা এখন অনেক সচেতন। তারা ক্লিনিকে নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছে। বড় কিছু হলে ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডিতে ভর্তি হয়। শিশু-নারীরা টিকাকেন্দ্রে গিয়ে টিকা নিচ্ছেন। ১৪ জুলাই তাঁদের টিকা কেন্দ্রে টিকা দেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে সিভিল সার্জন বলেন, কোনো ব্যক্তি যদি ক্লিনিকের জন্য জমি দেন, তাহলে স্থায়ীভাবে ক্লিনিক নির্মাণ করা যাবে।