রোহিঙ্গাদের জন্য এখন অন্যদের করার পালা

>

প্রথম আলোর মতবিনিময় সভায় তিন আলোচক বললেন, মিয়ানমারের সেনা সরকার নির্যাতন চালিয়ে গেছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বরাবরই চুপ।

রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া থেকে শুরু করে মিয়ানমারের সামরিক জান্তারা চার দশক ধরে পরিকল্পনামাফিক হত্যা, নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিধিব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে এসব কর্মকাণ্ড বহু বছর ধরে চলে এলেও জাতিসংঘসহ গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনগুলো চুপ করে থেকেছে। তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে।

তবে শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ ঠিক কাজটি করেছে। এর মধ্য দিয়ে দেশটি একটি নৈতিক শক্তি অর্জন করেছে। এখন বাংলাদেশের উচিত হবে তার ন্যায্য হিস্যাটা বুঝে নেওয়া। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যে রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ অনেক করেছে, অন্যদেরও করতে হবে।

গতকাল বুধবার প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় জন প্যাকার এই মন্তব্য করেন। তিনি কানাডার ইউনিভার্সিটি অব অটোয়ার হিউম্যান রাইটস রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন সেন্টারের পরিচালক। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় তিন দশক কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই গবেষক বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর যা চলছে, তা ‘ব্যাপক মাত্রার সুসংগঠিত মানবাধিকার লঙ্ঘন’। এর জন্য এককভাবে দায়ী মিয়ানমার সরকার।

জন প্যাকার ছাড়াও গতকাল মতবিনিময় সভায় অংশ নেন মং জার্নি এবং মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম। মং মিয়ানমারের নির্বাসিত নাগরিক ও ‘ফ্রি বার্মা কোয়ালিশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা। মেজর (অব.) এমদাদ বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ। সভাটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান।

আলোচকেরা মিয়ানমারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি, দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, প্রতিবেশী দেশগুলোর আচরণ, রোহিঙ্গা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের উদ্যোগ এবং বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে বক্তব্য দেন। তাঁরা বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সামনে এখন দুটো বিষয়-নাগরিক মর্যাদা নিয়ে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া এবং তাঁদের ওপর সংঘটিত নির্যাতনের ন্যায়বিচার।

মিয়ানমার কীভাবে আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ উপেক্ষা করেছে, তা ব্যাখ্যা করে জন প্যাকার বলেন, যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব নিয়ে এখন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তাদের ৯৮ শতাংশের জন্ম মিয়ানমারের স্বাধীনতার পর। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত এই জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্বের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ একক সিদ্ধান্তে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। আন্তর্জাতিক আইনে নাগরিকত্বের অধিকার স্বীকৃত এবং দেশগুলোর ওপর নাগরিকের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। মিয়ানমার সেটা মানেনি। কিন্তু তাতে করে আন্তর্জাতিক আইন বদলে যায়নি।

মিয়ানমার আন্তর্জাতিক আইন মানছে না। কিন্তু ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের কারণে ভারত ও চীন দুই দেশেরই মিয়ানমারকে খুশি করার চেষ্টা আছে। তাদের উদ্দেশে জন প্যাকার বলেন, ‘মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক আইনকে পাত্তা না দেওয়ার কারণে আইনের কাঠামোই দুর্বল হয়ে পড়ছে। ধরুন, যারা বিনিয়োগ করবে, তাদেরও মিয়ানমার সরকারের কথামতো চলতে হবে। যদি তারা না চলে, তাহলে কী হবে? তাদের কি তাড়িয়ে দেওয়া হবে? তাদের সম্পদ কি বাজেয়াপ্ত হবে? কী হবে কেউ জানে না।’

মং জার্নি জাতিসংঘ এবং এর অঙ্গসংগঠনগুলোর কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, সংগঠনগুলো বড় বড় কথা বলছে, কিন্তু রোহিঙ্গা নিয়ে কোনো আলোচনায় রোহিঙ্গাদেরই অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়নি। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার মধ্যে সম্প্রতি স্বাক্ষর হওয়া একটি গোপন চুক্তি ফাঁস হয়ে গেছে। সে নথিতে রোহিঙ্গা শব্দটিরই উল্লেখ নেই। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন মিয়ানমারে সেনা কর্মকর্তাদের সামনে দাঁড়িয়ে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন। অথচ, শব্দটি এখন আর বলা হচ্ছে না। এমনকি মিয়ানমারে জাতিসংঘের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিতর্কিত ভূমিকার অভিযোগ আছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কোনো তদন্ত করেননি।

অং সাং সু চির ভূমিকারও সমালোচনা করেছেন মং। তিনি বলেন, মিয়ানমারে কোনো গণতন্ত্র নেই, এমনকি ভঙ্গুর গণতন্ত্রও নেই। সু চি নামের ধূম্রজালের নিচে সামরিক জান্তার সমস্ত অন্যায়কে ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে।

এই পরিস্থিতি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হতে পারে বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মেজর (অব) এমদাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এখনো কোনো সহিংসতায় যুক্ত হয়নি। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের কোনো অবস্থান নেই, কোনো দূতাবাসে মানুষ জিম্মি করার নজির তাদের নেই। তবে নিপীড়িত মানুষের নিগ্রহ দ্রুত বন্ধ না হলে শুধু মিয়ানমার নয়, আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন৵ও হুমকি আসন্ন।

জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম। তিন বলেন, বিশ্বসম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে রসিকতা করছে। মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাদের নিয়ে একাধিক গবেষণার সঙ্গে জড়িত এমদাদুল ইসলাম রোহিঙ্গা সমস্যার ঐতিহাসিক নানা ঘটনাপরম্পরা তুলে ধরেন। প্রথমে ব্রিটিশ, পরে জাপানি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং খোদ মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীর কাছে নানা সময় রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর মানুষের নিগ্রহের চিত্র তুলে ধরেন তিনি। এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘সাম্রাজ্যবাদ, দেশীয় সামরিক শক্তির অত্যাচারের চারণভূমি রাখাইন রাজ্য আর এ রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।’

মিয়ানমারের দুই প্রতিবেশী এবং আঞ্চলিক শক্তিধর দেশ ভারত ও চীনের সমালোচনা করে এমদাদুল ইসলাম বলেন, কে কতটা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর কাছে যাবে, দুই দেশ তা নিয়েই ব্যস্ত। আর চীন যত দিন মিয়ানমারের পাশে আছে, দেশটি কাউকেই পাত্তা দেবে না।

রোহিঙ্গা সমস্যার তাহলে সমাধানের পথ কী? এমদাদুল ইসলাম মনে করেন, জাতিসংঘের আনান কমিশনের প্রতিবেদনে এ সমস্যার সমাধানের বিস্তারিত এবং গ্রহণযোগ্য উপায়ের বর্ণনা আছে। এতে জাতিসত্তা, নিরাপত্তা, দ্বিপক্ষীয় নানা সম্পর্কের বিস্তারিত আলোচনা আছে। আনান কমিশনের সেই প্রতিবেদনকে আমলে নেওয়ার কথা বলেন তিনি।

প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা মতবিনিময় সভার প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন