ঢাকায় 'অপহৃত' স্থপতিকে পাওয়া গেল খুলনায়

খালিশপুরে বোনের বাসায় সাংবাদিকদের কাছে অপহরণের ঘটনা বর্ণনা করেন স্থপতি বিএমএ মাহফুজ। খুলনা, ১২ জুলাই। ছবি: প্রথম আলো
খালিশপুরে বোনের বাসায় সাংবাদিকদের কাছে অপহরণের ঘটনা বর্ণনা করেন স্থপতি বিএমএ মাহফুজ। খুলনা, ১২ জুলাই। ছবি: প্রথম আলো

আবাসন প্রতিষ্ঠান শেলটেকের প্রধান স্থপতি বি এম এ মাহফুজকে খুলনায় পাওয়া গেছে। বুধবার গভীর রাতে কে বা কারা তাঁকে খুলনা নগরের খালিশপুর এলাকায় ফেলে যায় বলে জানিয়েছেন তিনি। ৮ জুলাই বেলা ১১টার দিকে ঢাকার ভাষানটেক এলাকার বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার পথে তিনি নিখোঁজ হন।

মাহফুজ বর্তমানে খালিশপুর এলাকায় তাঁর বোনের বাড়িতে আছেন। খালিশপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম বাশার তাঁর দূরসম্পর্কের মামা। আর ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ এম কামরুজ্জামান তাঁর ভগ্নিপতি।

মাহফুজ জানান, অপহরণের পর আটক থাকা অবস্থায় তাঁকে মারধর করা হয়েছে। তবে কেন তাঁকে অপহরণ করা হয়েছে, সেটা তিনি স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না। তাঁর ধারণা, মুক্তিপণের দাবিতে তাঁকে অপহরণ করা হয়ে থাকতে পারে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছবিসহ অপহরণের খবর প্রকাশিত হওয়ায় অপহরণকারীরা তাঁকে খুলনায় ফেলে রেখে গেছে।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে কামরুজ্জামানের বাড়িতে বসেই কথা হয় মাহফুজের সঙ্গে। ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছুটা অসুস্থ থাকায় ঘটনার দিন তিনি অফিসের উদ্দেশে একটু দেরিতে বের হন। বাস না পেয়ে একটি সিএনজি অটোরিকশায় মিরপুর ১০ নম্বর হয়ে খামারবাড়ি এলাকায় যান। সেখান থেকে ইন্দিরা রোড হয়ে রিকশা নিয়ে পান্থপথে তাঁর অফিসে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। ইন্দিরা রোডের মোড়ে দরজা খোলা একটি মাইক্রোবাসের ভেতর থেকে হঠাৎ একজন একটি কাগজে লেখা ঠিকানা দেখিয়ে পথনির্দেশনা চান। তিনি মাইক্রোর মধ্যে কিছুটা ঝুঁকে কাগজটা দেখতে গেলে তাঁকে জোর করে টেনে মাইক্রোতে তোলা হয়। এরপর আর কিছুই বলতে পারেন না বলে জানান তিনি।
মাহফুজ বলেন, যখন জ্ঞান ফেরে, তখন একটি ঘরের মধ্যে নিজেকে দেখতে পান। এক পা শিকল দিয়ে বাঁধা ছিল। ঘরের মধ্যে ছিল একটি ছোট খাট। বাথরুমে যাওয়ার মতো লম্বা ছিল শিকলটি। দিনে দুই বেলা শুধু রুটি আর ডাল ও পানি দেওয়া হতো খাওয়ার জন্য। যখন খাবার দেওয়া হতো, তখন অপহরণকারীরা সংকেত দিলে নিজের চোখ নিজেকেই বাঁধতে হতো। পরে ঘরে ঢুকে খাবার দিয়ে যাওয়া হতো। তিনি বলেন, মাঝেমধ্যে মারধর করা হতো। জানতে চাওয়া হতো ব্যাংকে থাকা টাকার পরিমাণ ও সম্পদের হিসাব। বেল্ট দিয়ে পিঠে ও পায়ের তলায় পেটানো হতো। শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার কারণে পায়ের গোড়ালির ওপর থাকা কাটা দাগ দেখান এ প্রতিবেদককে।
মাহফুজ আরও বলেন, অপহরণ হওয়ার আগে তাঁর ফ্রেন্স কাট দাড়ি ও লম্বা চুল ছিল। মঙ্গলবার হঠাৎ করে মেশিন দিয়ে চুল ছোট ও দাড়ি কেটে দেওয়া হয়। এরপর বুধবার আবার চোখ বেঁধে তাঁকে খুলনায় ফেলে রেখে যাওয়া হয়। তিনি বলেন, চোখ বেঁধে রাখা অবস্থায় কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চলার পর হঠাৎ তাঁকে নামিয়ে দেওয়া হয়। হাতে দেওয়া হয় একটি ছোট শপিং ব্যাগ। ওই ব্যাগে ছিল মোবাইল। বলা হয়, পেছন দিকে না তাকিয়ে সামনের দিকে হেঁটে যেতে। বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে যাওয়ার পর নিজেকে নিরাপদ মনে হওয়ায় চোখের বাঁধন খুলে ফেলেন তিনি। তখন দেখেন রাত। তবে কয়টা বেজেছে তা বলতে পারেন না। আরও কিছুক্ষণ সামনে হাঁটার পর খালিশপুরের গোয়ালখালী মোড়ের সড়কদ্বীপে থাকা নৌবাহিনীর ম্যুরাল জাহাজটি চোখে পড়ে। এরপর বুঝতে পারেন তিনি খালিশপুর এলাকায় আছেন। সেখান থেকে প্রায় দুই কিলোমিটারের বেশি দূরের মানসী সিনেমা হল এলাকায় থাকা মামার বাড়ি কিছুটা হেঁটে ও কিছুটা ভ্যানে করে যান। কিন্তু গেট বন্ধ থাকায় ওই বাড়িতে ঢুকতে পারেননি। পরে আবার সেখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে বোনের বাড়িতে চলে যান। গেটের কাছে গিয়েই চেতনা হারিয়ে ফেলেন।
মাহফুজ বলেন, সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র ছিল। সেখানে স্থায়ী ঠিকানা ছিল খুলনার খালিশপুরের মানসী সিনেমা হল এলাকার। এ কারণে তাঁকে খুলনায় ফেলে রেখে যাওয়া হতে পারে। মাইক্রোর ভেতরে তিনি অপহরণকারীদের বলতে শোনেন, ‘ঢাকার পরিস্থিতি খারাপ, সেখানে নেওয়া যাবে না।’ তাই হয়তো খুলনায় ফেলে রেখে গেছে।
আজ দুপুরেই মাহফুজের ভগ্নিপতি মো. ইমরান হোসেন খুলনায় এসে পৌঁছান। নিখোঁজ হওয়ার পর তিনিই থানাসহ বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর নিতেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘটনার দিন দুপুর থেকেই মাহফুজের মুঠোফোনটি বন্ধ ছিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো খবর না পাওয়ায় অফিসে যোগাযোগ করে জানা যায়, তিনি অফিসে যাননি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সন্ধান না পেয়ে পরদিন দুপুর ১২টার দিকে ভাষানটেক থাকায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়।
সোমবার সন্ধ্যার দিকে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ও পরে মাহফুজের নম্বর থেকে ফোন আসে। অপর প্রান্ত থেকে মাহফুজ তাঁদের কাছে আছে বলে জানান। এ সময় মাহফুজের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তাঁরা ফোন বন্ধ করে দেন। এরপর থেকে ওই নম্বরগুলোও বন্ধ বলে জানান ইমরান।

এ বিষয়ে খালিশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশাররফ হোসেন বলেন, খালিশপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে তাঁকে ফোন করে জানান, ঢাকা থেকে নিখোঁজ হওয়া স্থপতি মাহফুজকে পাওয়া গেছে। মাহফুজ তাঁর ভাগনে। তখন তাঁরা গিয়ে মাহফুজকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আসলে ঘটনাটি অপহরণ নাকি অন্য কিছু, সে সম্পর্কে তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলা যাবে।