দগ্ধ রোগীদের জ্বালা জুড়াতে অ্যাসিড-দগ্ধ তরুণীরা

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দগ্ধ রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী অ্যাসিড-দগ্ধ দুই তরুণী তৈরি করেন প্রেশার গার্মেন্ট বা চাপ পোশাক। ছবি: প্রথম আলো
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দগ্ধ রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী অ্যাসিড-দগ্ধ দুই তরুণী তৈরি করেন প্রেশার গার্মেন্ট বা চাপ পোশাক। ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের ১১৬ নম্বর কক্ষ। পর্দা সরিয়ে ঢুকতেই দুজন তরুণীকে দেখা গেল এক পোড়া রোগীর ‘প্রেশার গার্মেন্ট’র পোশাকটি বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এই দুই তরুণী পোড়া ক্ষতের শিকার—অ্যাসিড-দগ্ধ। নিজেদের পোড়া ক্ষতের দাগ নিয়ে অন্য পোড়া রোগীদের জন্য তৈরি করছেন প্রেশার গার্মেন্টের পণ্য। নিজের পায়ে দাঁড়াতে একটু একটু করে চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাঁরা।

প্রেশার গার্মেন্টের বাংলা হতে পারে ‘চাপ পোশাক’। চিকিৎসকেরা জানান, পোড়া রোগীদের ক্ষতস্থান শুকাতে শুরু করলে এ চাপ পোশাকের প্রয়োজন হয়। কারণ, পোড়া জায়গায় তখন ফুলে ওঠা, চুলকানিসহ বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়। এসব রোধে এ পোশাক পরতে হয়।

নার্গিস আক্তার ও শামীমা আক্তার এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাপ পোশাক তৈরি করেন। অ্যাসিড সারভাইভরস ফাউন্ডেশন (এএসএফ) থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁরা এখন অন্যদের জন্য পোশাক তৈরি করে দিচ্ছেন। ২০০১ সালে নার্গিস অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার হন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন। বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ায় তিনি এ নির্মমতার শিকার। এইচএসসির পাসের পর পড়াশোনা আর এগোয়নি।

প্রথম আলোকে নার্গিস বলেন, ‘এএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলাম। যোগাযোগটা সব সময়ই ছিল। আগে একটি কল সেন্টারে কাজ পেয়েছিলাম। পরে সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এএসএফ আমাকে এই প্রশিক্ষণ দেয়।’

ছয় মাস প্রশিক্ষণের পর নার্গিস দুই বছর ধরে এএসএফের অধীনে ঢাকা মেডিকেলে বসেই রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী চাপ পোশাক তৈরি করছেন। বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। সেখান থেকেই যাতায়াত করেন। প্রতিদিন গড়ে পাঁচ-ছয়টি অর্ডার পেয়ে থাকেন। বার্ন ইউনিটে তাঁদের ছোট্ট কক্ষটিতে দুটি সেলাই মেশিন আছে। সকাল আটটা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত নার্গিস কাজ করেন। মাসে যে টাকা পান, তা দিয়ে নিজের চলে যায়। পোশাকের কাপড় এএসএফ সরবরাহ করে।

নার্গিস বলেন, ‘এই কাজ করে নিজের কাছে শান্তিই লাগে। পোড়া রোগীদের কাপড় বানানো ছাড়াও অনেকেই হাসপাতালে এসে বোঝে না—কোথায় কার কাছে যেতে হবে। টাকাপয়সা দিয়ে হয়তো সাহায্য করতে পারি না, কিন্তু এ রকম সাহায্য করলেও শান্তি পাই।’

নার্গিসের সঙ্গে এ মাসে যুক্ত হয়েছে নওগাঁর শামীমা আক্তার। পড়াশোনা করতে চাওয়ায় স্বামী ঘুমের মধ্যে শরীরে অ্যাসিড ছুড়ে দেন। ২০১২ সালে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়েও শামীমা থেমে যাননি। নওগাঁতেই ডিগ্রি শেষ বর্ষে পড়ছেন। নিজ এলাকার স্কুলগুলোয় সচেতনতামূলক কাজ করেছেন বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ হয়ে। নিজের আয়ের জন্য এএসএফের কাছে জানান কিছু করবেন।

এরপর চাপ পোশাক তৈরির প্রশিক্ষণ নেন। শামীমা বলেন, ‘অ্যাসিডের শিকার অনেক মেয়েই মুখ ঢেকে চলে। আমি মনে করি, এটা তো আমার অপরাধ না। আর দশজনের মতো স্বাভাবিকভাবেই চলব। মানুষের নানা কথা শুনি। কখনো প্রতিবাদ করি, কখনো পাত্তা দিই না।’

শামীমার লক্ষ্য পড়াশোনা শেষ করে সরকারি কোনো চাকরি করা।

চাপ পোশাক তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়ে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও দুজন কাজ করছেন। তাঁরা এই হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের রোগীদের জন্য চাপ পোশাক সরবরাহ করেন। তাসলিমা আক্তার কাজ শুরু করেছিলেন নার্গিসের সঙ্গেই। বাবার সঙ্গে শত্রুতার জের ধরে ২০০১ সালে বিরোধী পক্ষের ছোড়া অ্যাসিড বয়ে বেড়াচ্ছেন শরীরে। স্বামী ও দুই মেয়ে নিয়ে এখন ঢাকায় থাকেন। পরিবারের সচ্ছলতার আশায় নিজেও কাজে নেমেছেন। তাসলিমা বলেন, ‘একা বের হতে সাহস পেতাম না। লজ্জা লাগত। কিন্তু নিজের তো চলতে হবে। কে কত দিন নিয়ে বের হবে। সাহস করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টায় কাজ শুরু করেছি।’

একই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছেন রোকসানা বেগম। ২০০৫ সালে স্বামীর বাড়িতে বিরোধী পক্ষের ছোড়া অ্যাসিডে ঝলসে যায় রোকসানা ও তাঁর বড় ছেলের শরীর। ঘটনার চার-পাঁচ বছর স্বামী সঙ্গে থাকলেও অত্যাচার শুরু করায় দুই ছেলেকে নিয়ে বের হয়ে যান। রোকসানা বলেন, ‘যেই স্বামীর জন্য আমার এই অবস্থা, সে-ই আমাকে আর দেখতে পারত না। আমার বাবার বাড়ির অবস্থাও ভালো না। কিন্তু ছেলেদের তো মানুষ করতে হবে। সে জন্যই এএসএফকে বলি কাজ দিতে।’ রোকসানা মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালিয়েছেন। এখন ঢাকায় ছোট ছেলেকে নিয়ে বস্তিতে ঘর ভাড়া করে থাকছেন। দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া বড় ছেলেকে পড়াচ্ছেন খুলনার এক হোস্টেলে রেখে।

এএসএফের নির্বাহী পরিচালক সেলিনা আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশের বাইরে থেকে প্রশিক্ষক এসে এই পোশাক তৈরির প্রশিক্ষণ দেন। ২০০২ সালে এ কার্যক্রম শুরু হয়। এখন পর্যন্ত ১৩ জন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাঁর মধ্যে পাঁচজন এখনো এ পেশার সঙ্গে যুক্ত আছেন। অন্যরা বিভিন্ন পেশায় চলে যায়। মেডিকেলের চারজন ছাড়া আয়শা এএসএফ হাসপাতালেই অন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং ওই হাসপাতালের জন্য চাপ পোশাক তৈরি করেন। সেলিনা আহমেদ বলেন, ‘এ প্রশিক্ষণের ফলে একদিকে যেমন অ্যাসিড-দগ্ধদের কর্মসংস্থান হচ্ছে। অন্যদিকে অ্যাসিড-দগ্ধ বা পোড়া রোগী বাদে অনেকেরই এ পোশাক তৈরি হয়। তাঁদেরও উপকার হচ্ছে।’ তিনি জানান, ঢাকা মেডিকেল ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সঙ্গে তাঁদের একটি চুক্তি হয়েছে। যেখানে হাসপাতাল তাঁদের জায়গা দেবে এবং তাঁরা চাহিদা অনুযায়ী পোশাক তৈরি করে দেবেন।

বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের জাতীয় সমন্বয়কারী সামন্ত লাল সেন প্রথম আলোকে বলেন, পোড়া রোগীদের জন্য এই চাপ পোশাক খুবই প্রয়োজনীয়। এটা ব্যবহার না করলে ক্ষতস্থান ফুলে যাওয়া ছাড়া বিভিন্ন সমস্যা হয়। এ দেশে এই পোশাক সহজে পাওয়া যায় না। এএসএফ কম দামে বার্ন ইউনিটের রোগীদের সরবরাহ করে। তবে জানান, বার্নের জন্য যে ইনস্টিটিউট তৈরি হচ্ছে, সেখানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ পোশাক সরবরাহের ব্যবস্থা করবে।