রাজশাহীতে খুলনার বাতাস!

বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল গতকাল রাজশাহী নগরের বিশ্ববিদ্যালয় রোডে প্রচারণা চালান।  প্রথম আলো
বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল গতকাল রাজশাহী নগরের বিশ্ববিদ্যালয় রোডে প্রচারণা চালান। প্রথম আলো
>

• বিএনপি বলছে, তফসিল ঘোষণার পর হয়েছে তিন মামলা
• মোট আসামি ১৭৮। এ পর্যন্ত আটক ২৯ 
• তবে খারাপ কিছু দেখছে না আওয়ামী লীগ

রাজশাহীতে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ধরপাকড়, বাড়ি বাড়ি অভিযান এবং নাশকতা পরিকল্পনার অভিযোগে ও বিস্ফোরক আইনে নতুন মামলা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিএনপি বলছে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নতুন তিনটি মামলা দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় মোট আসামি ১৭৮। এ পর্যন্ত আটক করা হয়েছে ২৯ জনকে। এসব ঘটনা খুলনা নির্বাচনের পূর্বাভাস হিসেবে দেখছে বিএনপি।

বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল প্রথম আলোকে বলেন, সরকার খুলনা ও গাজীপুরের মতো নির্বাচনী এজেন্টদের তাড়িয়ে দেওয়া বা ভোটের আগেই এলাকাছাড়া করার পাঁয়তারা করছে। সে জন্য তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁর প্রত্যেক নির্বাচনী এজেন্টের নাম-পরিচয় ও ছবি স্থানীয় পত্রিকায় ছেপে দেবেন। নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও সেই তালিকা দেবেন। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়নি। যেভাবে ভীতিকর পরিবেশ তৈরির চেষ্টা চলছে, তা খুলনা স্টাইলের নির্বাচনের পূর্বাভাস বলে মনে হচ্ছে।

অবশ্য বিএনপি প্রার্থীর এ আশঙ্কাকে অমূলক মনে করছে আওয়ামী লীগ। দলটির মেয়র প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন প্রথম আলোকে বলেন, ‘খুলনা ও গাজীপুরের নির্বাচনে কী হয়েছে, আমি জানি না। আমরা খারাপ কিছু দেখিনি। তবে রাজশাহীতে তেমন কিছু করার দরকার নেই। এখানে খারাপ কিছু হবে, সেটা আমি মনে করি না।’ তিনি বলেন, এখানে ভয় দেখানোর দরকার নেই। এমনিতে বিএনপির এজেন্ট-সংকট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রবল। তাই এজেন্ট হতে কেউ রাজি না-ও হতে পারে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর তিনটি থানায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে তিনটি নতুন মামলা করেছে পুলিশ। এসব মামলায় গ্রেপ্তার আছেন ৬ জন, আসামি ১৭৬। পুলিশের ভাষ্য, নাশকতার পরিকল্পনা ও বিস্ফোরক দ্রব্য বহন এবং ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে এসব মামলা করা হয়েছে।

তবে বিএনপি বলছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে রাজশাহী মহানগর এলাকায় একটি ককটেলও ফোটেনি। এসব সাজানো মামলা। নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত গুরুত্বপূর্ণ নেতা-কর্মীদের আসামি করা হয়েছে। আবার অজ্ঞাতনামা আসামিও রয়েছে, যাতে যে কাউকে ধরে এসব মামলায় কারাগারে পাঠানো যায়।

সর্বশেষ মামলা দেওয়া হয়েছে গত বৃহস্পতিবার রাজপাড়া থানায়। বাদী পুলিশের উপপরিদর্শক টি এম সেলিম রেজা। এজাহারে বলা হয়, তেরখাদিয়া স্টেডিয়ামের ভেতরে ক্রিকেট গ্রাউন্ডে বসে বিএনপি-জামায়াতের ১৫-২০ জন নেতা-কর্মী নাশকতা ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপের জন্য গোপন বৈঠক করেছেন। তাঁদের মধ্যে এজাহারে ১৬ জনের নাম আসামির ঘরে উল্লেখ করা হয়। তিনজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তাঁরা হলেন রাজপাড়া থানার তেরখাদিয়া এলাকার নূরুল ইসলাম (৩৫), তেরখাদিয়া স্টেডিয়ামপাড়া এলাকার সাজ্জাদুল হক (৬৫) ও নতুন বিলসিমলা এলাকার দিলদার আলী ওরফে জনি (৩২)।

রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এই তিনজন জামায়াতের কর্মী। নাশকতার উদ্দেশ্যে গোপন বৈঠকের সময় তিনজনকে ধরা হয়েছে। অন্যরা পালিয়ে গেছে।

বিএনপি বলছে, এজাহারভুক্ত আসামিদের বেশির ভাগই তাদের নেতা-কর্মী। এর মধ্যে ৫ নম্বর আসামি শফিকুল ইসলাম রাজপাড়া বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বিএনপি ত্যাগ করেছিলেন। তাঁকেও আসামি করা হয়েছে। শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় পাঁচ বছর আগে তিনি বিএনপি ছেড়েছেন। মামলার কথা শুনে তিনি অবাক হয়েছেন।

এর আগে ৮ ও ৯ জুলাই নগরের কাশিয়াডাঙ্গা থানায় দুটি মামলা করে পুলিশ। এজাহারে বলা হয়, ৭ জুলাই আনুমানিক বেলা সাড়ে তিনটার সময় কাশিয়াডাঙ্গা থানার চার খুঠার মোড়ের উত্তরে মাঠের মধ্যে দেড় শতাধিক নামকরা দুষ্কৃতকারী অপরাধমূলক কার্যকলাপের জন্য জমায়েত হয়। গোপান সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ গেলে তারা পুলিশশের উদ্দেশেককটেল নিক্ষেপ করে। তখন পুলিশ ধাওয়া করলে অন্যরা পালিয়ে যায়। পুলিশের দাবি, সেখান থেকে ১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক নূরুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি আমিনুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে এই দুজনসহ আরও দেড় শ অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে নাশকতার পরিকল্পনা ও বিস্ফোরক দ্রব্য বহনের অভিযোগে দুটি মামলা দিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়।

রাজশাহী নগরের এক অনুষ্ঠানে ভোটারদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন আ.লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন।  প্রথম আলো
রাজশাহী নগরের এক অনুষ্ঠানে ভোটারদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন আ.লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন। প্রথম আলো

আমিনুল ইসলামের স্ত্রী তামান্না শিরিন প্রথম আলোকে বলেন, আমিনুলকে ৭ জুলাই রাত সাড়ে ১১টার দিকে বাসার ফটক থেকে আটক করে পুলিশ। পরদিন তাঁকে সাজানো মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। আমিনুল একজন ক্রীড়াবিদ। তিনি ভারোত্তোলনের জন্য স্বর্ণপদক পেয়েছেন।

৯ জুলাই বোয়ালিয়া থানা পুলিশ ১৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি শফিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে। তাঁকেসহ বিএনপির আটজনকে আসামি করে মামলা দেয় পুলিশ। তাতে ষষ্টিতলার থিম ওমর প্লাজার সামনে থেকে লাঠি, দেশীয় অস্ত্র, ককটেল ব্যবহার করে এক ব্যক্তির ওপর হামলার অভিযোগ আনা হয়।

বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও রাজশাহীর সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু অভিযোগ করেন, তাঁদের এ পর্যন্ত ২৯ নেতা-কর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। শত শত নেতা-কর্মীর বাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছে।

বিএনপির ২৯ জনকে আটকের অভিযোগ সম্পর্কে মহানগর পুলিশের মুখপাত্র জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার ইফতে খায়ের আলম বলেন, পুলিশের নিয়মিত মাদকবিরোধী ও নাশকতাবিরোধী অভিযানে কেউ আটক হতে পারে। এর মধ্যে রাজনৈতিক কারণে কোনো আটক বা অভিযান নেই।

পুলিশের অভিযানের বাইরেও রাজশাহীতে পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা ও প্রচারে বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া সব জায়গায় সরকারি দলের প্রার্থীর পোস্টার-ফেস্টুনে ছেয়ে যাওয়ায় অন্যদের জন্য কোনো খালি জায়গা নেই বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপিসহ অন্য দলের প্রার্থীরাও। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি তাঁর দলের মেয়র প্রার্থী মুরাদ মোর্শেদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারের সময় প্রথম আলোকে বলেন, সারা শহরে কেবল একজন প্রার্থীর পোস্টার-ফেস্টুন। যেন আর কোনো প্রার্থী নেই। এই যে বিপুল অর্থ ব্যয় চলছে, তাতে নির্বাচন কমিশনের কোনো রকম তদারকি নেই।

রিটার্নিং কর্মকর্তা সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেন, ১০ জন ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ নিয়ে শহরে সারা দিন ঘুরছেন। কোথায় কে কী অনিয়ম করছেন, তাঁরা এগুলো দেখবেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রশাসনের হস্তক্ষেপের শামিল। নির্বাচন কমিশনের উচিত বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা। কেননা এ ধরনের তৎপরতার মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। এখন বল নির্বাচন কমিশনের কোর্টে, দেখা যাক তারা কী করে।