গণিতে সোনাজয়ী দল দেশে ফিরেছে

১২ জুলাই ৫৯তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড আসরে সোনার পদক পায় বাংলাদেশ। দেশের হয়ে প্রথম সোনার পদকটি জিতেছে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী। বাবা-মার সঙ্গে জাওয়াদ চৌধুরী। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
১২ জুলাই ৫৯তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড আসরে সোনার পদক পায় বাংলাদেশ। দেশের হয়ে প্রথম সোনার পদকটি জিতেছে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী। বাবা-মার সঙ্গে জাওয়াদ চৌধুরী। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে সোনা ও ব্রোঞ্জ মেডেলজয়ী বাংলাদেশি গণিত দল দেশে ফিরেছে। আজ শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকার হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে তারা দেশে পৌছায়। বিজয়ী দল জানায়, তারা দেশের জন্য কাজ করবে।

১২ জুলাই ৫৯তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড (আইএমও) আসরে সোনার পদক পায় বাংলাদেশ। রোমানিয়ার ক্লুজ-নাপোকা শহরে এই আন্তর্জাতিক আসরে দেশের জন্য প্রথম সোনার পদকটি জিতেছে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী। সে ৪২ নম্বরের মধ্যে পেয়েছে ৩২।

বিমানবন্দরে জাওয়াদ প্রথম আলোকে বলে, ‘বাংলাদেশ থেকে প্রথমবার এমন পদক পেয়ে অনেক ভালো লাগছে। প্রথম আলো ও ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক ও গণিত অলিম্পিয়াড কমিটিকে ধন্যবাদ। যখন পুরস্কার নিচ্ছিলাম তখন চিন্তা হচ্ছিল বাংলাদেশের পতাকাটা ঠিকমতো ধরছি কি না। পতাকার অ্যাঙ্গেল ঠিক করার জন্য একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। পরে দেখলাম ঠিকই আছে।’

জাওয়াদ আরও বলে, ‘প্রথম দিনটা আমাদের জন্য ভালো ছিল। দ্বিতীয় দিনের পুরো দলের জন্য পরিস্থিতি কিছুটা কঠিন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরে আমরা বুঝতে পারি যে আমরা গোল্ড মেডেল পেতে যাচ্ছি।’

চ্যালেঞ্জগুলো কী কী ছিল এমন প্রশ্নে জাওয়াদ বলে, ‘আমাদের গণিতের প্রতি একটা ভীতির অনুভূতি আছে। তবে এই দেশে যে গণিত উৎসবটা হয় তা সবচেয়ে বড় ও ইউনিক। অন্য দেশগুলোতে অলিম্পিয়াড বড় হলেও এত বড় আকারে উৎসব হয় না। আমরা আস্তে আস্তে উন্নতি করছি। এত দিন গোল্ড না পাওয়াটা দুর্ভাগ্য ছিল। এর আগে যারা অংশ নিয়েছিল, তারা অনেক ভালো করেছিল।’

জাওয়াদ তার স্বপ্নের কথা জানায় প্রথম আলোর কাছে। সে বলে, ‘বড় হয়ে কী হব, তা এখনো ঠিক করিনি। তবে বড় হয়ে মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। যারা গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে চায়, তাদের উদ্দেশে শুধু বলব যে দেশে গণিতের যে ক্যাম্প হয়, সেসবে অংশ নেওয়া আর গণিতের মজাটা সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া। এটাই আমাদের সামনে আরও এগিয়ে নেবে।’

বিজয়ী দলের সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান। বিমানবন্দরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এইবার শুরু থেকেই আমাদের আশা ছিল যে স্বর্ণপদকটা পাব। প্রথম দিনের পরীক্ষায় যখন জাওয়াদ বের হয়ে বলল তিন নম্বরে তিন পাবে, তখনই আমরা বুঝেছি এবার সোনার পদক আমাদের হবে।’ গণিত অলিম্পিয়াডে আগামীর লক্ষ্য নিয়ে তিনি বলেন, সামনের লক্ষ্য হলো ভবিষ্যতেও সোনার পদক নিশ্চিত করা। এটাই এখন টার্গেট।

২০০৯ সালে আইএমওতে প্রথম বাংলাদেশের ব্রোঞ্জ পদক আসে। আর ২০১২ সালে প্রথম সিলভার পদক আসে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এ বছর আইএমওতে এটাই একমাত্র সোনা। এবারের আসরে বিজয়ী দলের অপর তিন সদস্য তাহনিক নূর সামিন (২৩ নম্বর), জয়দীপ সাহা (১৯ নম্বর) ও তামজিদ মুর্শেদ রুবাব (১৮ নম্বর) পেয়ে ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছে। অপর দুই সদস্য রাহুল সাহা ও সৌমিত্র দাস সম্মানজনক স্বীকৃতি অর্জন করেছে।

বিজয়ী দলকে বহনকারী বিমানটি বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটে পৌঁছানোর কথা থাকলেও তা ৫টা ৫৬ মিনিটে অবতরণ করে। বিমানবন্দরের বাইরে অভিভাবকদের অপেক্ষা আরও ঘনীভূত হয়। তাঁরা ফুল হাতে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন টার্মিনালের গাড়ি বারান্দার বাইরে। আর বিজয়ী দল ভিআইপি টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে আসে ৭টা ২০ মিনিটের দিকে। প্রথমেই বিজয়ী দলকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানান উপফিচার সম্পাদক পল্লব মোহাইমেন ও বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।

এরপর বিজয়ী দলের সদস্য ও অভিভাবকেরা তাঁদের অনুভূতি প্রকাশ করেন। জাওয়াদের বাবা আহমদ আবু জোনায়েদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ব্যক্তিগত অর্জনের চেয়ে দেশের জন্য এটা বড় একটা অর্জন। এর পেছনে ওর মায়ের অবদানটাই বেশি।

জাওয়াদের মা সৈয়দা ফারজানা খানম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে ওর অঙ্কের প্রতি একটা ভালোবাসা ছিল। ছোটবেলায় কিছু মেন্টাল অ্যারিথমেটিক ক্লাসে ওকে ভর্তি করিয়েছিলাম। তাকে খুব বেশি পড়ার চাপ দিতাম না। অঙ্কের প্রতি ভালোবাসা ওর ভেতর ঢুকিয়েছিলাম, পরে ও নিজেই অঙ্ককে ভালোবাসছে। আমরা চাই জাওয়াদ দেশের জন্য ভবিষ্যতে উদ্ভাবনী ও গবেষণামূলক কাজ করুক।’

জাওয়াদের নানু মোমেনা খানম তাকে অভিনন্দন জানাতে বিমানবন্দরে আসেন। নাতির অর্জনে তিনিও খুশি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার এত বড় খুশি আর জীবনে হয়নি। ছোটবেলা থেকে সে খুব লক্ষ্মী ছিল, কখনো খেলনা নষ্ট করত না।’

ব্রোঞ্জ পদকজয়ী তাহনিক নূর সামিন প্রথম আলোকে বলে, ‘প্রতিবছর ২৩ নম্বরেই সিলভার পদক আসে। আমি ভেবেছিলাম সিলভার পাব। কিন্তু তা না আসায় তখন মন কিছুটা খারাপ ছিল। পরে ভাবলাম আমরা তো গোল্ড পেতে যাচ্ছি। তখন মন ভালো হলো। গত কয়েক বছরের মতো যদি আমরা অলিম্পিয়াডের ৩ ও ৬ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে এভাবে নম্বর পেতে থাকি, তাহলে আগামীবার থেকে বড় দেশগুলোকে প্রতিযোগিতায় হারাতে পারব।’

ফরিদপুরের গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় আসেন শ্যামল চন্দ্র দাস। ছেলে সৌমিত্র দাস দলের সদস্য হয়ে সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছে। শ্যামল চন্দ্র বলেন, ২০১৬ সালে সৌমিত্র আঞ্চলিক পর্যায়ে গণিত অলিম্পিয়াড বিজয়ী হয়। দেশের ছেলেরা এত বড় বিজয় নিয়ে ফিরছে বলে গর্ব হচ্ছে।

প্রথম আলোতে সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র বিজ্ঞান প্রজন্ম পাতায় ২০০১ সালে ‘নিউরনে অনুরণন’ নামে প্রথম গণিত অলিম্পিয়াডের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০৩ সালে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি আয়োজকের দায়িত্ব নেয়। সেই থেকে ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় প্রতিবছর সারা দেশে গণিত উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। আর নির্বাচিতরা আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে যোগ দিচ্ছে ২০০৫ সাল থেকে।