সংশয়ের বিপরীতে অভয়

প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকের এক মুহূর্তে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন ও বিএনপির মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। গতকাল রাজশাহী চেম্বার ভবনের সভাকক্ষে।  শহীদুল ইসলাম
প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকের এক মুহূর্তে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন ও বিএনপির মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। গতকাল রাজশাহী চেম্বার ভবনের সভাকক্ষে। শহীদুল ইসলাম
>
  • সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। শেষ পর্যন্ত ভোট যুদ্ধে থাকা নিয়ে সংশয় বুলবুলের।
  • পরিবেশ বিঘ্নিত হয় এমন কাজ করতে দেওয়া হবে না জানালেন লিটন।

রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার পরিবেশ বা লক্ষণ নেই বলে দাবি করেছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। এই অবস্থায় শেষ পর্যন্ত তাঁর ভোটযুদ্ধে থাকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সদ্য বিদায়ী এই মেয়র। তবে তাঁকে অভয় দিয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ বিঘ্নিত হয় এমন কোনো কাজ করতে দেওয়া হবে না। তিনি তাঁর কর্মীদের অতি উৎসাহী হয়ে কিছু না করার জন্য ইতিমধ্যেই সতর্ক করেছেন বলে জানান।

গতকাল শুক্রবার প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে তাঁরা এসব কথা বলেন। রাজশাহী শিল্প ও বণিক সমিতির বোর্ড কক্ষে ‘কেমন নির্বাচন চাই’ শীর্ষক এ বৈঠকে চার মেয়র প্রার্থী ছাড়াও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহ আছে। মানুষ অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়। সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু কমিশন তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না। তিনি বলেন, ‘আজকাল নির্বাচনের বিভিন্ন মডেলের কথা বলা হচ্ছে। রাজশাহীতে আপনারা কী মডেল উপহার দেন, সেটা আমরা দেখব। আশা করি, এখানে একটি ভালো নির্বাচন আমরা দেখতে পাব।’

আলোচনায় অংশ নিয়ে নতুন ভোটার ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা সুন্দর পরিবেশে ভোট গ্রহণের পাশাপাশি আধুনিক বাসযোগ্য শহর গড়ে তোলার দাবি জানান।

বৈঠকটি রুদ্ধকার কক্ষে হলেও প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। এ সময় পাশাপাশি বসে প্রধান দুই দলের প্রার্থীর কানে কানে কথা বলা, একজনের বক্তৃতার সময় আরেকজনের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করা, দুজন মিলে হাসাহাসি করার দৃশ্য বৈঠকটি উপভোগ্য করে তোলে। দুই প্রার্থীর এই সহাবস্থান রাজশাহীর রাজনৈতিক সম্প্রীতির বার্তা দেয় বলে মত দেন অংশগ্রহণকারীরা।

নগরজুড়ে শুধুই নৌকা প্রতীকের পোস্টার-ফেস্টুন লাগানোর সমালোচনা করে মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, সংরক্ষিত একজন নারী কাউন্সিলরও পোস্টার লাগানোর জায়গা পাচ্ছেন না। তাহলে নির্বাচন কি এ রকমই? নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার পরিবেশ নেই দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমার মা পর্যন্ত গতকাল বলেছে, “বাবা, এই নির্বাচনে তুই বসে যা। নির্বাচনে তুই জিততে পারবি না। কে নাকি জিতে আছে। ” এই উপলব্ধি যদি হয়, তাহলে তো নির্বাচন করে কোনো লাভ নেই!’
বিএনপির প্রার্থী বলেন, ‘পোলিং এজেন্টরা ৩০ তারিখে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে যদি বাড়ি থেকে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেন, তাহলে আমি নির্বাচনে থাকব। আর যদি যেতে না পারেন, তাহলে নির্বাচন কমিশনকে মাঠে নামতে আমরা দেব না। পোলিং অফিসার যদি সিল মেরে একজন প্রার্থীর পক্ষে ভোট দেন, সেই নির্বাচন আমরা চাই না।’

জবাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বলেন, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বুলবুলসহ অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কি না। খুলনার মডেল কাকে বলে আমি জানি না, গাজীপুর মডেল কাকে বলে আমি জানি না। বড় আকারের সুস্পষ্ট প্রমাণ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বা কেউ দিতে পারবে না যে ওই সব নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বা এজেন্টদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’

তরুণ ভোটার নোশিন আতিয়ার সংশয়ের জবাবও দেন খায়রুজ্জামান। আতিয়া বলেছিলেন, ‘আমরা এর আগে বিভিন্ন নির্বাচনে দেখেছি, ভোটার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখতে পাচ্ছেন, তাঁর ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। আমি কি আমার ভোট দিতে পারব? কয়েক দিন আগে রাজশাহীতে ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে। আমি কি নিরাপদে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারব?’ খায়রুজ্জামান জবাবে বলেন, ‘আমরা দেখি তো ৩০ তারিখ সে ভোট দিতে যেতে পারে কি না। আমি আশাবাদী, নিশ্চয়ই সে ভোট দিতে পারবে।’

সাবেক মেয়র বিএনপির নেতা মিজানুর রহমান মিনুর প্রশংসা করে খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘এই শহরটিকে সবুজায়ন করার ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদান ছিল। তাঁর ধারাবাহিকতা আমি ধরে রাখতে পেরেছিলাম। এই শহরে আগে যে পদ্মার ধূলি এসে, বালি এসে ঘরবাড়ি আচ্ছাদিত করে দিত। সেই অবস্থা এখন আর নেই।’

খায়রুজ্জামান বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর নগরের প্রধান রাস্তাগুলো নির্মাণে গুরুত্ব দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনটা বড় রাস্তা করতে গিয়ে আমার ৩০ হাজার ভোট কমে গিয়েছিল। কারণ, রাস্তার দুই পাশে যাদের বাড়িঘর ভাঙা পড়েছিল, তারা আর আমাকে ভোট দেয়নি।’ গত নির্বাচনে বুলবুল তাঁকে এ কথা বলেছিলেন বলেও তিনি স্মরণ করিয়ে দেন। তখন বুলবুলসহ উপস্থিত সবাই হেসে ওঠেন।

গণসংহতি আন্দোলন-সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী মুরাদ মোর্শেদ বলেন, ‘আমরা এমন সিটি করপোরেশন চাই, যেখানে নাগরিকেরাই হবেন সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি।’

বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী হাবিবুর রহমান বলেন, সিটি করপোরেশনে দলীয় বিবেচনায় কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ হলে ভালো কাজ পাওয়া যায় না। তিনি সিটি করপোরেশনকে দলবাজির ঊর্ধ্বে রাখার পরামর্শ দেন।

রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, যিনিই মেয়র নির্বাচিত হোন, তাঁকে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। নগরবাসীর সুবিধা-অসুবিধা, সমস্যার কথা শোনার জন্য মেয়রকে দিনে অন্তত এক ঘণ্টা নির্দিষ্ট করে সময় দিতে হবে।

রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক সাদরুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সম্ভাবনাময় রাজশাহীকে গ্রিন সিটি, ক্লিন সিটি হিসেবে দেখতে চাই।’

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রাজশাহী জেলার সভাপতি আহমদ সফিউদ্দিন বলেন, ‘যিনি মেয়র হবেন তাঁকে শুধু আগামী পাঁচ বছরের কথা ভাবলে হবে না। আগামী ৫০ বছর পর শহরকে কেমন দেখতে চাই, সেই পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে।’

রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ রাজশাহীর সাধারণ সম্পাদক মনিরা রহমান বলেন, নগরে উদার সাংস্কৃতিক পরিবেশ না থাকলে জ্ঞানচর্চা ব্যাহত হয়। একটি উদার সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। নগরে সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্র তৈরি করতে হবে।

রাজশাহী উইমেন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি রোজেটি নাজনীন বলেন, নির্বাচনের পর সাধারণ জনগণকে যেন মেয়রের দুয়ারে এসে ফেরত যেতে না হয়, তাঁদের যেন সেবা পেতে নিগৃহীত হতে না নয়। নারীদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলে তাঁদের ক্ষমতায়নের উপযুক্ত পরিবেশ নগরে নিশ্চিত করতে হবে।

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সিটি করপোরেশনকে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন করতে হবে।

ভবিষ্যৎ মেয়রের জন্য করণীয় সম্পর্কে বক্তব্য দেন আরেক নতুন ভোটার জাহিদ হাসান।

গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান। স্বাগত বক্তব্য দেন, উপসম্পাদক লাজ্জাত এনাব মহছি।