অভিযোগ আমলে নিচ্ছে না ইসি

আচরণবিধি ভঙ্গ করে আ.লীগ প্রার্থীর অনুষ্ঠানে সরকারি গাড়ি নিয়ে যোগ দেন দক্ষিণ সুরমা উপজেলা চেয়ারম্যান আবু জাহিদ। গতকাল সিলেটের মির্জাজাঙ্গাল এলাকায়।  প্রথম আলো
আচরণবিধি ভঙ্গ করে আ.লীগ প্রার্থীর অনুষ্ঠানে সরকারি গাড়ি নিয়ে যোগ দেন দক্ষিণ সুরমা উপজেলা চেয়ারম্যান আবু জাহিদ। গতকাল সিলেটের মির্জাজাঙ্গাল এলাকায়। প্রথম আলো

বিরোধীদের কোণঠাসা করতে গ্রেপ্তার-হয়রানি, প্রচারে আচরণবিধি লঙ্ঘন আর একে অন্যের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা-তিন সিটির নির্বাচনে এ পর্যন্ত এগুলোই আলোচিত বিষয়। মূল প্রার্থীরা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগও জমা দিচ্ছেন। কিন্তু রিটার্নিং কর্মকর্তারা কিছু কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েই দায় সারছেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বড়জোর একই কাজ না করার মুচলেকা দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন।

৩০ জুলাই রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশনে ভোট গ্রহণ। ১০ জুলাই থেকে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরুর পর আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ মেয়র প্রার্থীরা ৯০টি অভিযোগ জমা দিয়েছেন। কিন্তু রিটার্নিং কর্মকর্তারা তেমন কিছুই করেননি।

সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আচরণ বিধিমালায় কোনো প্রার্থী বা তাঁর পক্ষে অন্য কেউ আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ছয় মাস কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান আছে। আর কোনো রাজনৈতিক দল বা কোনো প্রার্থীর পক্ষে কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়ার বিধান আছে। এমনকি আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে তদন্ত সাপেক্ষে প্রার্থিতা বাতিল করারও ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) রয়েছে।

ইসি সূত্র জানায়, ইসি আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়টি তদন্তের ভার পুলিশকেই দিয়ে দেয়। এতে ভোটের আগে আর কিছু হয় না। আর ভোটের দিন বড় কোনো অঘটন হলে কমিশন নিজেই অনেক সময় তদন্ত করে। তবে গণমাধ্যমে আলোচিত কিছু ঘটনা ছাড়া খুব কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নজির কম।

জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ভোটে অভিযোগ আসেই। কেউ সঠিক অভিযোগ করে, কেউ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বানোয়াট অভিযোগও করে। তবে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে সব অভিযোগই গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। আর ইসির উচিত রিটার্নিং কর্মকর্তাকে সাহস দেওয়া, যাতে অর্পিত দায়িত্ব পালনে কুণ্ঠাবোধ না করেন। পুলিশি গ্রেপ্তার বা হয়রানির বিষয়গুলো নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়ার ক্ষমতা আইনে ইসিকে দেওয়া হয়েছে। এখন কমিশন কীভাবে কোন বিষয়টি সমাধান করবে, তা তাদের ওপর নির্ভর করে।

রাজশাহীতে এগিয়ে আ. লীগ

রাজশাহী সিটি করপোরেশনে অভিযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সবার চেয়ে এগিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির মেয়র প্রার্থীর পক্ষ থেকে ৫৩টি অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। আর বিএনপির মেয়র প্রার্থীর পক্ষে ৯টি চিঠিতে ২৩টি অভিযোগ জমা দেওয়া হয়েছে। বিএনপি বলছে, অভিযোগের কোনো প্রতিকার পায়নি। আর আওয়ামী লীগ বলছে, তাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তর থেকে জানানো হয়নি। রিটার্নিং কর্মকর্তা বলছেন, তাঁরা সব অভিযোগেরই ব্যবস্থা নিয়েছেন।

রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তর সূত্র জানায়, দুই দলের প্রার্থীর দেওয়া অভিযোগ প্রায় একই। বিএনপির প্রার্থীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২৩ জুলাই পর্যন্ত তাঁদের ৪৩ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেককে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেককে পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। এর বাইরে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে সাংসদদের প্রচারণায় নামা, বিএনপির প্রার্থীর পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, কার্যালয় ভাঙচুর ও কর্মীদের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ উল্লেখযোগ্য। 

আওয়ামী লীগের প্রার্থীর অভিযোগ, তাঁর নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের বাড়িতে রাতে পুলিশ হানা দিয়েছে। এর ফলে কর্মী, সমর্থক ও ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর বাইরে ভোটারদের অর্থের লোভ দেখানো, পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, দলীয় কার্যালয় ভাঙচুরসহ নানা অভিযোগ দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
স্থানীয় ভোটার ও রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বেশির ভাগ অভিযোগ, রিটার্নিং কর্মকর্তাকে চাপে রাখার জন্য। বিএনপির অভিযোগ নিয়ে যাতে রিটার্নিং কর্মকর্তা তৎপর না হন, সেই কৌশল থেকেই এমন অভিযোগ করা হয়েছে।

বরিশালে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ
বরিশালে গত ১৫ দিনে ২৪টি অভিযোগ জমা পড়েছে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে। এর বেশির ভাগই আচরণবিধি লঙ্ঘনের। রিটার্নিং কর্মকর্তা অভিযোগের পর সতর্ক করা এবং কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে।

বরিশালে এ পর্যন্ত বিএনপির পক্ষ থেকে সাতটি, আওয়ামী লীগের পক্ষে পাঁচটি এবং বাসদের একটি অভিযোগ পড়েছে। এর মধ্যে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও পরিচালকের আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়ার অভিযোগটি গুরুতর। রিটার্নিং কর্মকর্তার কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবে দুঃখ প্রকাশ এবং ভবিষ্যতে এ কাজ না করার মুচলেকা দিয়েছেন তিনি।

এর বাইরে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী কাজে সার্কিট হাউস ব্যবহার, নির্ধারিত সময়ের পরও মাইক ব্যবহার, নির্বাচনী প্রতীক নৌকার বেআইনি প্রদর্শন ইত্যাদি। অন্যদিকে বিএনপির বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ হচ্ছে সরকারি অফিসের সামনে নির্বাচনী অফিস স্থাপন, পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা এবং বেআইনিভাবে মিছিল করা। আর ইসলামি আন্দোলনের প্রার্থীর বিপক্ষে নির্বাচনী কাজে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ব্যবহারের অভিযোগ করা হয়।

রিটার্নিং কর্মকর্তা বিএনপি ও আওয়ামী লীগ, ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। কাউকে সতর্ক করেই দায় সেরেছে রিটার্নিং কর্মকর্তা। কেউ দুঃখ প্রকাশ করে অব্যাহতি পান।

সিলেটে অভিযোগ কম
সিলেটে এ পর্যন্ত আচরণবিধি লঙ্ঘনের ১৩টি আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে তিনটিতে সতর্ক করা হয়েছে, দুটিতে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েই দায় সেরেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ হচ্ছে, সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের নার্স ও কর্মচারীরা নৌকার পক্ষে প্রচারণা। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তির নৌকার পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেওয়ার অভিযোগ।