সিলেট সিটি নির্বাচনে নারী কাউন্সিলররা: নারীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা পালনের প্রতিশ্রুতি

প্রার্থীদের প্রচারে উৎসবের নগর এখন সিলেট। নগরের দরগা গেট এলাকার পুরো সড়কটি পোস্টারে ঢাকা পড়েছে। ছবি: আনিস মাহমুদ, সিলেট।
প্রার্থীদের প্রচারে উৎসবের নগর এখন সিলেট। নগরের দরগা গেট এলাকার পুরো সড়কটি পোস্টারে ঢাকা পড়েছে। ছবি: আনিস মাহমুদ, সিলেট।

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থীরা নির্বাচিত হওয়ার পর ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাকতে চান না। নগরের উন্নয়নে নিজেদের মেধা ও যোগ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে চান তাঁরা। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও চান—এই নারী কাউন্সিলররা সবার আগে নিজেদের ক্ষমতায়িত করুন। এরপর নাগরিক সেবায় নিজেদের দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিক।

সিলেট সিটি করপোরেশনের নয়টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদের জন্য ৬২ জন নারী লড়ছেন। সাধারণ ওয়ার্ডে লড়ছেন একজন নারী। সিলেটের মতো রক্ষণশীল এলাকায় এত বিপুলসংখ্যক নারীর নির্বাচনে অংশ নেওয়াকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন বিভিন্ন স্তরের নারীরা। সিটি নির্বাচনে যে ৬৩ জন নারী লড়ছেন, তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মী, সমাজসেবীর পাশাপাশি গৃহবধূও আছেন। নির্বাচনে ভোটারদের দৃষ্টি কাড়তে প্রতিদিনই ছুটে বেড়াচ্ছেন ভোটের মাঠে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাইছেন ভোট।

এসব নারীদের সবাই জানেন, নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কথা। সিলেটের নির্বাচনে অংশ নেওয়া অন্তত ১৫ জন নারী প্রার্থীর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁদের প্রায় একই কথা। প্রতিটি সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন একটি ওয়ার্ড থেকে। আর নারীদের নির্বাচনে জিতে আসতে হয় তিনটি ওয়ার্ড থেকে। তারপরও নির্বাচিত হওয়ার পর নারীরা হয়ে যান শোভাবর্ধকের মতো। সড়কে একটি লাইট লাগাতে গেলেও কাউন্সিলরকে বলতে হয়। নারী কাউন্সিলরদের জন্য আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই।

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সিলেট বিভাগীয় সভাপতি সৈয়দা শিরিনা আক্তারের পর্যবেক্ষণ হলো, নারী কাউন্সিলররা সুবিধা পান না। তাঁদের ক্ষমতায়িত করা হয় না এবং কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেওয়া হয়। তাঁর প্রত্যাশা নারী কাউন্সিলররা নির্বাচনের পর নারীবান্ধব কাজে নিজেদের ভূমিকা বাড়াবেন। তিনি বলেন, নির্বাচিত হওয়ার পর নারী কাউন্সিলরদের প্রথমে নিজেদের জন্য লড়তে হবে, পরে অন্যদের জন্য।

সাংস্কৃতিক সংগঠক নাজমা পারভীন চান, নির্বাচিত নারী কাউন্সিলররা নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে উদ্যোগ নেবেন। তাঁরা বেকার নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজের উপযোগী করে তোলাসহ নারীদের নিরাপত্তার বিষয়ে ভূমিকা নেবেন।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাজিয়া চৌধুরীর প্রত্যাশা, নারী কাউন্সিলররা অন্তত নারীদের জন্য আস্থার জায়গা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করবেন। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত বা ছিন্নমূল নারীদের জন্য কাজ করবেন তাঁরা।

এই নাগরিক সমাজের প্রত্যাশার সঙ্গে কাউন্সিলর প্রার্থীরাও একমত। তাঁরাও চান নারীদের আস্থা পেতে এবং সেভাবে নিজদের তুলে ধরতে। পাশাপাশি তিনটি ওয়ার্ডের ভোটারদের জন্য কাজ করতে চান তাঁরা।

সিলেট সিটি করপোরেশনের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ও এবারের কাউন্সিলর প্রার্থী শামীমা স্বাধীন বলেন, ‘আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারি না। আমরা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হই। কিন্তু আমাদের বলা হয় সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। কেন এটা বলা হয়, সেটাই বুঝতে পারি না।’

৫ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী দীবা রানি দে বলেন, নারী কাউন্সিলরদের ক্ষমতা সম্পর্কে তিনি জানেন। আর সেই কারণে মানুষকে কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া সম্ভব হয় না।

৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ছামিরুন নেসা বলেন, ‘ভোটের মাঠে আমি কোনো ওয়াদা করি না বা প্রতিশ্রুতি দিই না। আমাদের জন্য যে সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, সেটা বিবেচনা করেই কাজ করব।’

১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী আছিয়া বেগম জানালেন, নগরের সবগুলো ওয়ার্ডে তাঁর পরিচিতি রয়েছে। সমাজসেবাই তাঁর নেশা। যত সীমাবদ্ধতাই থাকুক না কেন সবকিছু অতিক্রম করে ভোটারদের সেবা দেবেন বলে তিনি জানান। প্রয়োজনে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেবা দেবেন বলে জানিয়েছেন।

৬ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী ইদ্রানী সেন বলেন, নারীদের মূল্যায়নে এখনো দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যা রয়ে গেছে পুরো সমাজে। নারী কাউন্সিলরদের ভোটারদের কাছে জবাবদিহি আছে, কিন্তু ক্ষমতায়ন নেই। নির্বাচিত হলে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ক্ষমতায়নের জায়গাটি সুনিশ্চিত করতে লড়াই করবেন বলে জানালেন তিনি।

২ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী শেলীনা রাজা বলেন, ‘সবার আগে নিজেদের ক্ষমতায়িত করার চেষ্টা করব। সমঝোতা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে ভোটারদের স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা করব।’

বেসরকারি সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক শাহ শাহেদা মনে করেন, নিজেদের ক্ষমতায়িত করার জন্য নারীদেরই আওয়াজ তোলা উচিত। সরকারেরও উচিত নারী কাউন্সিলরদের কাজের সুযোগ-সুবিধা ও পরিধি আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া।