আত্মবিশ্বাসে টগবগে আ.লীগ, হাল ছাড়েনি বিএনপি

এ এইচ এম খায়রুজ্জামান (লিটন) ও মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন (বুলবুল)
এ এইচ এম খায়রুজ্জামান (লিটন) ও মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন (বুলবুল)

নির্বাচনী প্রচারের কাজে ব্যবহার করা শব্দযন্ত্রের কোলাহল শেষ হয়েছে শনিবার মধ্যরাতে। রাত পোহালেই ভোট রাজশাহী সিটিতে। তবুও থেমে নেই নীরব জনসংযোগ। কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে এখনো ভোট চাচ্ছেন। আর শীর্ষ নেতারা বসেছেন ভোটের কূটকৌশল প্রণয়নে। কষছেন শেষ মুহূর্তের ভোটের হিসাব-নিকাশ। 

রাজশাহী সিটি নির্বাচনের বর্তমান যে পরিস্থিতি, তাতে দৃশ্যত মাঠে সাংগঠনিকভাবে টগবগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে নানান চাপের মুখে কোণঠাসা থাকা বিএনপি।
নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তাদের মেয়র প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বলেছেন, ভোটের ফল যা-ই হোক না কেন, তিনি তা মেনে নেবেন। এমন আত্মবিশ্বাসের মধ্যেও ভোটের অতীত হিসাব-নিকাশ বিশ্লেষণ করে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে আওয়ামী শিবির।
অন্যদিকে বিএনপি প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বরাবরই বলে এসেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। সরকারি দল কেন্দ্র দখল করবে। সে রকম কিছু ঘটলে তারাও কেন্দ্র দখল করবেন, থানা ঘেরাও করবেন এবং নির্বাচন কমিশনের ইট-বালু খুলে নিয়ে আসবেন।
এমন হতাশার মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে বুলবুল আশাবাদী হয়ে উঠছেন, তিনি জিতবেন। কারণ শহরের নাম ‘রাজশাহী’। ভোটের ময়দানে এই শহরের নাম মুখে নেওয়ার আগে বলতে হয়, ‘জামায়াত-বিএনপি অধ্যুষিত’। আজও তিনি নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করতে বলেছেন, হাজার বাধার মধ্যেও তারা কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে ভোট দিতে যাবেন।

যে কারণে উজ্জীবিত আওয়ামী লীগ
এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি উজ্জীবিত করেছে, তা হলো ভোটের অতীত পরিসংখ্যান। ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রয়াত জাতীয় নেতা এ এইচ এম কামরুজ্জামান দুটি আসন (রাজশাহী শহর ও গোদাগাড়ী) থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে তিনি গোদাগাড়ী আসনটি রেখে শহরের আসনটি ছেড়ে দেন। উপনির্বাচনে জাসদ প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন আওয়ামী লীগ প্রার্থী। এরপর থেকে ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত রাজশাহী শহরের আসনে (বর্তমানে রাজশাহী-২) আওয়ামী লীগ কখনো জয় পায়নি।
১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজশাহীর সিটির (রাজশাহী-২) এই আসনে বিএনপির প্রার্থী কবির হোসেন পেয়েছিলেন ৮১ হাজার ১৪ ভোট। আওয়ামী লীগ প্রার্থী মাহবুব উজ জামান ভুলু পেয়েছিলেন মাত্র ২৪ হাজার ৪৭ ভোট। ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে হেরে গিয়েও আওয়ামী লীগ প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন পেয়েছিলেন ৭৫ হাজার ৮০৩ ভোট। বিএনপি প্রার্থী কবির হোসেন পেয়েছিলেন ১ লাখ ৮ হাজার ৫৭১ ভোট। অষ্টম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মিজানুর রহমান মিনু ১ লাখ ৭৬ হাজার ৪০৫ পেয়ে জয়ী হন। লিটন পান ৯৬ হাজার ৬০৪ ভোট।
পাশা উল্টে যায় ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে। সেবার আওয়ামী লীগ জোটের প্রার্থী ফজলে হোসেন বাদশা ১ লাখ ১৬ হাজার ৫৯৯ ভোট পেয়ে জয়ী হন। মিনু পান ৮৯ হাজার ৫০ ভোট। এর মাধ্যমে রাজশাহী সিটিতে প্রথমবারের মতো পরাজয়ের স্বাদ পায় বিএনপি (সেনা শাসক এরশাদের শাসনামল বাদে)।
রাজশাহী সিটি নির্বাচনের ফলও আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমমনা সংগঠনগুলোর জন্য ইতিবাচক। ২০০৮ সালের সিটি নির্বাচনে ৯৮ হাজার ৩৬০ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন খায়রুজ্জামান লিটন। বিএনপি প্রার্থী বুলবুল পান ৭৪ হাজার ৫৫০ ভোট। ২০১৩ সালের নির্বাচনে ৮৩ হাজার ৭২৬ ভোট পেয়ে হেরে যান লিটন। ১ লাখ ৩১ হাজার ৫৮ ভোট পেয়ে জয়ী হন বুলবুল।
১৯৭৩ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ভোটের এই পরিসংখ্যান বলে দেয়, আওয়ামী লীগের ভোট ধাপে ধাপে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। সে তুলনায় বিএনপি-জামায়াত জোটের ভোট বাড়েনি। ভোটের এই চিত্র এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে।

পরাজয় থেকে শিক্ষা
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব মনে করে, ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল স্থানীয় নেতাদের মধ্যকার বিরোধ। একই সময়ে হেফাজতে ইসলামের সরকারবিরোধী ভূমিকাও ক্ষমতাসীন দলটিকে নাজুক অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল।
মহানগর আওয়ামী সাংগঠনিক সম্পাদক আসলাম সরকার বলেন, এবার আওয়ামী লীগের দলীয় পর্যায়ে ন্যূনতম কোনো বিরোধ নেই। আর মাঠের পরিস্থিতিও অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো। যে কারণে আওয়ামী লীগের জয় সুনিশ্চিত।

আত্মবিশ্বাসের আরও কারণ
অভিযোগ আছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের মাঠপ্রশাসনের হস্তক্ষেপে গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচনে জয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী। রাজশাহীতেও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ লক্ষণীয়। পুলিশ গত কয়েক দিনে নগর বিএনপির উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতা-কর্মীকে আটক করে অন্য জেলায় পাঠিয়ে দিয়েছে।
রাজশাহীর ভোটে বিএনপির অন্যতম রাজনৈতিক শরিক জামায়াতে ইসলামী। ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ও মহানগর জামায়াতের নেতা আমিনুল ইসলাম আজ প্রথম আলোকে বলেন, নগরীর আটটি থানার জামায়াতের আমির ও সেক্রেটারিদের বেশির ভাগই কারাগারে। যাঁরা বাইরে আছেন, তাঁরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। যে কারণে এবারের নির্বাচনে জামায়াত সাংগঠনিকভাবে বিএনপির মেয়র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার সুযোগ পায়নি।
জামায়াতের দায়িত্বপ্রাপ্ত আমির অধ্যাপক আবুল হাশেম আজ সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে দৃশ্যমান কোনো কারচুপি দেখা যাবে না। কিন্তু বিএনপি প্রার্থীকে হারানোর পরিবেশ আগে তৈরি হয়ে গেছে। যেমনটা হয়েছে গাজীপুর ও খুলনাতে।
আরও জানা যায়, বিভিন্ন ধরনের মামলা-হামলায় জর্জরিত নগর বিএনপি-জামায়াতের একাধিক নেতা পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন। অনেকের মতে, মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে তাঁরা এই কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন।

একেবারে দমে যায়নি বিএনপি
এবারের নির্বাচনে রাজশাহী সিটির ভোটার ৩ লাখ ১৮ হাজার ১৩৮ জন। স্থানীয় লোকজনের ধারণা, ৩০ শতাংশের বেশি ভোটার চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা। এঁদের সিংহভাগই বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক। জেলা বিএনপির সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এসব ভোটার নিরাপদে কেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ পেলে বিএনপির জয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।
নগর বিএনপির নেতারা মনে করেন, বর্তমানে দলগতভাবে রাজশাহী শহরে আওয়ামী লীগের ভোটার বেশি। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের মিলিত ভোট আওয়ামী লীগের চেয়ে উল্লেখযোগ্য বেশি। সুতরাং এই বিবেচনাতেও বিএনপি প্রার্থী এগিয়ে আছেন।
এবারের নির্বাচনে বিএনপির প্রচার বাড়ি বাড়ি বা পাড়া-মহল্লায় গিয়ে জনসংযোগ করা এবং সংবাদ সম্মেলনে সীমাবদ্ধ ছিল। পোস্টার-ব্যানার বা শব্দযন্ত্রের ব্যবহার তারা তেমন একটা করেনি।
তোফাজ্জল হোসেন বলেন, দৃশ্যত সবাই আওয়ামী লীগ। কিন্তু মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে দৃশ্যমান হিসাব উল্টে যাবে।