বাল্যবিবাহ ঠেকাতে লাল মানবের লাল প্রতিরোধ

বাল্যবিবাহের ভয়াবহতা বোঝাতে আনোয়ার হোসেনের ব্যবহার্য সবকিছুই লাল। ছবি: প্রথম আলো
বাল্যবিবাহের ভয়াবহতা বোঝাতে আনোয়ার হোসেনের ব্যবহার্য সবকিছুই লাল। ছবি: প্রথম আলো

আনোয়ার হোসেনের সারা গায়ের পোশাক ও অন্যান্য সরঞ্জামে বাল্যবিবাহবিরোধী নানা বার্তা লেখা। লাল শার্টের সামনে লেখা, ‘বাল্যবিয়েকে লাল কার্ড দিন’। ‘বাল্যবিয়েকে না বলুন’। শার্টের পেছনে লেখা, ‘হতে চাই না বিয়ের পাত্রী, হতে চাই স্কুলের ছাত্রী’।

আনোয়ার হোসেন তালুকদার। ৫০ বছর পার হওয়া আনোয়ার হোসেনকে লাল মানব বলা যায়। তাঁর গায়ে লাল শার্ট, লাল পায়জামা, লাল টুপি, লাল জুতা, লাল মাইক, লাল বাঁশি—এমনকি তাঁর বাইসাইকেলটিও লাল রঙের। বাইসাইকেলে লাল রঙের পতাকা।

গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে সোনারগাঁও হোটেলে আনোয়ার হোসেন তাঁর বাইসাইকেল এবং অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। জাতিসংঘ শিশু তহবিল-ইউনিসেফ, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল-ইউএনএফপিএসহ বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয় ‘ইচ্ছে ডানা’ নামে ২৬ পর্বের একটি ধারাবাহিক নাটক প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশনে।

এ ধারাবাহিক নাটকে দেখা যাবে আনোয়ার হোসেন তালুকদারকে। ইউনিসেফের সহায়তায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত কৈশোরের শক্তি উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে অংশ নিতেই বগুড়ার আনোয়ার হোসেন তালুকদার এসেছিলেন রাজধানীতে।

অনুষ্ঠান শেষে পরিচয়ের প্রথমেই আনোয়ার হোসেন তাঁর হাতে ধরা লাল কাপড়ের ব্যাগ থেকে লিফলেট বের করলেন। তাতে বাল্যবিবাহের কুফল এবং বাল্যবিবাহ নিয়ে তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কথা লেখা। হাসিমুখে জানালেন, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত ৬৭ দিনে বাইসাইকেলে ভ্রমণ করে ৬৪ জেলায় গেছেন। প্রতিবেদকের ভ্রু কুঁচকানো দেখে বললেন, ‘অনেকেই অবাক হন। কিন্তু আমার কাছে ৬৪ জেলায় যে গেছি, ডিসি অফিস থেকে নেওয়া সিল আছে। যেমন ধরেন, বরিশাল, ভোলা দিনে গেলাম। রাতে পটুয়াখালী থাকলাম। এভাবে ঘুরছি।’

আনোয়ার হোসেন গত মঙ্গলবার সোনারগাঁও হোটেলে তাঁর বাইসাইকেল ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। ছবি: প্রথম আলো
আনোয়ার হোসেন গত মঙ্গলবার সোনারগাঁও হোটেলে তাঁর বাইসাইকেল ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। ছবি: প্রথম আলো

সবকিছু লাল কেন—এ প্রশ্নের উত্তরে আনোয়ার হোসেন বলেন, বাল্যবিবাহ মানেই বিপজ্জনক একটি বিষয়। এ বিষয়ের ভয়াবহতা বোঝানোর জন্যই সবকিছু লাল।

বাল্যবিবাহ রুখতে কেন তিনি পথে নামলেন, এ প্রশ্নের উত্তরে আনোয়ার হোসেন জানালেন, তাঁর ১৪ ও ১৫ বছর বয়সী দুই ভাগনির বিয়ে হয়ে যায়। দুজনের একটি করে সন্তান হলেই তাদের স্বামী তাদের ফেলে চলে যায়। কিছুদিন পরে তাদের বাবাও মারা যান। চরম দুর্ভোগে পড়ে দুই বোন। এখন তারা পোশাকশিল্প কারখানায় কাজ করছে। বিয়ে নিয়ে বীভৎস অভিজ্ঞতার কারণে তারা আর দ্বিতীয় বিয়ে করার সাহস পায়নি। ওদের কষ্ট দেখে, পত্রপত্রিকায় বাল্যবিবাহের খবর পড়ে এর বিরুদ্ধে কিছু একটা করার তাড়া অনুভব করেন। নিজের একটি আসবাবের দোকান ছিল, তা বিক্রি করে সাইকেল কেনাসহ অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে পথে নামেন।

এরপরের অভিযান দেশের সব উপজেলার অন্ততপক্ষে একটি করে স্কুলে যাওয়া। এ পর্যন্ত গিয়েছেন ৯০টি উপজেলায়। তিনি বগুড়ায় একটি আসবাবের দোকানে কাজ করেন। আর শীতকালে বেরিয়ে যান বাল্যবিবাহের কুফল জানানোর জন্য। একেকটি স্কুলে হাজির হয়ে হাতের মাইকে বাল্যবিবাহের কুফল, কেন বাবা-মা মেয়ের বাল্যবিবাহ দেবেন না—সেসব তথ্যের রেকর্ড বাজান। পরে লিফলেট দেন সবাইকে। এরপর আবার অন্য উপজেলার দিকে রওনা দেন।

পরিবার বা অন্যরা তাঁর এ কাজকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন—প্রশ্নে হাসি ও কান্না মিশিয়ে আনোয়ার হোসেন বলেন, শুরুতে সবাই তাঁকে পাগল ডাকা শুরু করে দিয়েছিল। স্ত্রীও মাঝেমধ্যে এটাকে পাগলামি বলতেন। একটু থেমে প্রথম আলোকে ধন্যবাদ দিয়ে জানালেন, ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে তাঁকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর অন্যান্য পত্রিকা এবং টেলিভিশন তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার ও প্রকাশ করতে থাকে। এরপর থেকে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে।

দুই মেয়ে ও দুই ছেলের জনক আনোয়ার হোসেন। দুই মেয়েকে বেশি দূর পড়াতে পারেননি, কিন্তু ১৮ বছর বয়সের আগে মেয়েদের বিয়েও দেননি। ছেলেরা এখনো ছোট।

আনোয়ার হোসেনের বাড়ি বগুড়ার সদর উপজেলার বারপুর গ্রামের উত্তরপাড়ায়। কোনো জায়গায় বাল্যবিবাহ হচ্ছে, সে খবর শুনলে তিনি নিজে চেষ্টা করেন বা প্রশাসনের সহায়তায় তা বন্ধ করার চেষ্টা করেন।

নিজ উদ্যোগে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জেলা, উপজেলায় ঘুরতে, লিফলেট ছাপাতে খরচ একেবারে কম না। তবে এখন পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি পর্যায় থেকে তিনি তেমন কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি। ২০১৫ সালে বগুড়া জেলা প্রশাসক আশরাফ উদ্দিনের কাছ থেকে একটি প্রত্যয়নপত্র পেয়েছেন। তাতে আনোয়ার হোসেনের কার্যক্রম উল্লেখ করার পাশাপাশি সবাইকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছেন।

আনোয়ার হোসেন তালুকদার বললেন, জেলা, উপজেলায় গেলে সরকারের পক্ষ থেকে রাতে যদি একটু থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়, তাহলে খরচ ও ঝামেলাটা কম হতো।