নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নিয়ে নাগরিক মন্তব্য

আনিসুজ্জামান, জাতীয় অধ্যাপক
আনিসুজ্জামান, জাতীয় অধ্যাপক

প্রতিবাদ ন্যায্য
আনিসুজ্জামান, জাতীয় অধ্যাপক

ছাত্রদের প্রতিবাদের ধরন সম্পর্কে সমালোচনা থাকতে পারে, কিন্তু এর কারণ সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ একমত; এর কারণ ন্যায্য বলে মনে করি। সড়কপথে যে নৈরাজ্য চলছে, তা অবিলম্বে এবং স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়া দরকার। যেসব সন্তানের প্রাণ ঝরে গেছে, তার জন্য আমি গভীর শোক অনুভব করি। এবং তাদের পরিবারের প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি জানাই।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শিক্ষাবিদ
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শিক্ষাবিদ

বাস্তবতা উন্মোচিত হলো
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শিক্ষাবিদ

সড়ক নিরাপদ নেই। যাত্রী মেরে পানিতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ দুজন শিক্ষার্থীকে বাস চাপা দিল। সড়ক নিরাপদ ছিল না—এই বিষয়টি অনেক দিন চাপা পড়ে ছিল। শিক্ষার্থীরা সবার সামনে নিয়ে এসেছে। দুর্ঘটনার খবরে মন্ত্রীরা যখন মুখে হাসি এনে কথা বলেন, তখন এটা পরিষ্কার হয় যে রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় কোনো জবাবদিহি নেই।

জবাবদিহি নেই পুলিশেরও। পুলিশের সদস্যরা তাঁদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেন না। অন্যদিকে দুর্ঘটনায় পুলিশের আয় বাড়ে। রাষ্ট্র ও পুলিশের জবাবদিহি না থাকার প্রভাব পড়ে চালকের ওপর। একসময় শ্রমিকনেতা মালিক হয়। এখন মালিকেরাই রাষ্ট্রক্ষমতায়। অদক্ষতা ও নৈরাজ্য জায়গা করে নিয়েছে সবখানে।

শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাস্তবতা উন্মোচিত হয়েছে। ছেলেমেয়েরা নিঃস্বার্থভাবে পথে নেমেছে। তাদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততা আছে। তাদের মুনাফার কোনো লোভ নেই। তারা দেখিয়েছে, মানুষের মধ্যে অনেক শক্তি আছে, তারা অনেক কিছু করতে পারে। দেশের মানুষের এই শক্তিকে সব সময় চাপা দিয়ে বা দমিয়ে রাখা যায় না।

সড়কে ট্রাফিক বাতি কোনো কাজে লাগে না—এই অভিজ্ঞতা নগরবাসীর আছে। আবার শিক্ষার্থীরা দেখিয়েছে, সড়কে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সম্ভব।

পরিস্থিতির উন্নতি করার মূল দায়িত্ব সরকারের। সরকারের সঙ্গে মালিকের সম্পর্ক আছে। আর মালিকের আশকারা আর উসকানিতে চালকেরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সরকারের উচিত মালিকদের জবাবদিহির আওতায় আনা। তাহলে চালকও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসবে। একমাত্র জবাবদিহিই পারে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। 

অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, জাতীয় অধ্যাপক
অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, জাতীয় অধ্যাপক

আন্দোলন একাধিক দুর্ঘটনার ফল
অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, জাতীয় অধ্যাপক

শিক্ষার্থীদের এই বর্তমান আন্দোলন মূলত সাম্প্রতিক কালের একাধিক দুর্ঘটনার ফল। এসব দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীরা প্রাণ হারিয়েছে, অনেকে আহত হয়েছে। প্রতিটি ঘটনাই দুঃখজনক, বেদনার।এসব দুর্ঘটনার একটি প্রধান কারণ—বাস ও ট্রাকচালকদের বড় অংশের লাইসেন্স না থাকা। এর অর্থ, এদের প্রশিক্ষণ নেই, এরা নিয়মনীতি না জেনেই রাস্তায় বাস-ট্রাক চালাচ্ছে। একসময় বলা হতো, ৯০ শতাংশ চালকের বৈধ লাইসেন্স নেই। এখন অবস্থার কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে, ঠিক জানা নেই।

রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা পরিস্থিতিকে অবনতির দিকে নিতে সহায়তা করেছেন। তাঁদের কেউ কেউ বলেছেন, গাড়িচালকদের লেখাপড়া জানার দরকার নেই। চালকেরা সড়কের পাশের ছবি, সংকেত বুঝতে পারলেই চলবে। একজন চালক ঠিকমতো গাড়ি চালাতে পারে কি না, তা পরীক্ষা করার কার্যকর ব্যবস্থা নেই। পরীক্ষা না দিয়েই তারা রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছে।

দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ চালকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, বিমানবন্দর সড়কে দুর্ঘটনায় দুজন শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনার পেছনে ছিল একই কোম্পানির দুটি বাসের প্রতিযোগিতা। মালিকেরা চালকদের বেতন কম দেন। চালকেরা বেশি যাত্রী তোলার জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামে। একে অন্যকে ওভারটেক করে। এসব কারণে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু এসব দেখা যাদের দায়িত্ব তারা নির্বিকার। আশা করি, শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের ফলে তাদের টনক নড়বে, পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

ঢাকার ২০ বছরের জন্য কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় এক নম্বর সুপারিশ ছিল, পথচারীদের জন্য ফুটপাত রাখতে হবে। ফুটপাত থাকলে দুর্ঘটনা কম হয়। কিন্তু সব সড়কে ফুটপাতের ব্যবস্থা করছে না সরকার।

দ্বিতীয় সুপারিশ ছিল রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি করা। যেমন মিরপুর থেকে মতিঝিল একটা রুট। এই রুটে শুধু একটি কোম্পানির গাড়ি চলবে। একটি কোম্পানির গাড়ি চললে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হবে না। এতে লাভ যা হবে তা শেয়ারহোল্ডাররা ভাগ করে নেবে। সরকার একসময় এমন উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু মনে হয় মালিকদের চাপে পিছিয়ে আসে। বর্তমান পরিস্থিতি নীতিনির্ধারকদের জন্য বড় ধরনের ব্যর্থতা।

অন্য একটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে। ফিটনেস নেই এমন গাড়ি সারা দেশে চলাচল বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি সব এক্ষুনি বন্ধ করলে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে। একটা সময় সীমা ধরে ধাপে ধাপে করতে হবে। তবে কাজটি এক্ষুনি সরকার শুরু করে দিতে পারে। 

রাশেদা কে চৌধূরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
রাশেদা কে চৌধূরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

আইনের দৃশ্যমান বাস্তবায়ন চাই
রাশেদা কে চৌধূরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে একেক ধরনের অনাস্থা প্রকাশ পেয়েছে। শিক্ষার্থীরা আমাদের ওপর ভরসা করতে পারছে না। তারা বাধ্য হয়েই রাস্তায় নেমেছে। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের এই আন্দোলন মানুষ সমর্থন করেছে। মানুষ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশে কটু কথা বলেনি।

সড়কে মৃত্যুর অবসান আমরা চাই। অচলাবস্থারও অবসান দরকার। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আছে। আদালতের আছে। এই নির্দেশনার দৃশ্যমান বাস্তবায়ন আমরা চাই। এটা যেন লোকদেখানো বিষয় না হয়ে দাঁড়ায়।

পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে কিছু কাজ নিয়মিত করতে হবে। সড়কের নৈরাজ্য দূর করতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে মাঠে নামাতে হবে, যেমন তাঁরা ভেজাল খাদ্যের ব্যাপারে রমজান মাসে তৎপর ছিলেন। লাইসেন্স দেখা, অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক চিহ্নিত করা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি ধরা—এগুলো নিয়মিতভাবে করতে হবে। আইনের প্রয়োগ দৃশ্যমানভাবে করতে হবে। অভিযান চালাতে হবে নিরবচ্ছিন্নভাবে।

আমরা জানতে পেরেছি, এ বিষয়ে একটি আইন হতে যাচ্ছে। আইনটি খুব দ্রুততার সঙ্গে পাস করা হলে নানা সীমাবদ্ধতার আশঙ্কা আছে। আমি অনুরোধ করব, আইনটি ওয়েবসাইটে দেওয়া হোক। সবাই যেন তাতে মতামত দেওয়ার সুযোগ পান। আইনে জনমতের প্রতিফলন থাকা বাঞ্ছনীয়।

আরেকটি বিষয়ে জোর দিতে চাই। রাস্তায় এখন কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। এরা রাজনীতি করে না, রাজনীতি বোঝে না। এরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমেছে। এদের আন্দোলন নিয়ে যেন কেউ রাজনীতি করার সুযোগ না পান, বা না নেন, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। 

ইলিয়াস কাঞ্চন, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, নিরাপদ সড়ক চাই
ইলিয়াস কাঞ্চন, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, নিরাপদ সড়ক চাই

হত্যাকাণ্ড সরকার আমলে নিচ্ছে না
ইলিয়াস কাঞ্চন, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, নিরাপদ সড়ক চাই

দীর্ঘদিনের ক্ষোভ থেকে শিশুরা-শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছে। এর আগেও সড়কে শিক্ষার্থী মারা গেছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, পরিবহন খাতে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। এবং সেই হত্যাকাণ্ডকে সরকার আমলে নিচ্ছে না। আগের অনেক ঘটনার বিচার না হওয়ায় এখনকার ঘটনাগুলো ঘটছে।

শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেছে, পুলিশ ছাত্রীদের গায়ে হাত দিয়েছে। এগুলো ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা দেখেছে, রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল মানুষ ঠিকমতো দায়িত্ব পালন না করে মৃত্যুর ঘটনায় হেসেছেন। শিশুরা বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। তারা ক্ষুব্ধ হয়েছে।

আমাদের অনেক কথাতেই সরকার কান দেয় না। দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে অনেক কথা হয়। সরকার শোনে না। কিন্তু আমি নিরাপদ সড়কের কথা প্রায় ২৫ বছর ধরে বলে চলেছি। কারণ, এখানে মৃত্যু আছে। দুর্ঘটনায় বহু মানুষ প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। এদিকে নজর দেওয়া দরকার। কিন্তু সরকার নজর দিচ্ছে না।

দিচ্ছে না তার কারণ, সরকারের কিছু দায়িত্বশীল মানুষের সঙ্গে শ্রমিকদের সম্পর্ক আছে। এসব দায়িত্বশীল মানুষ শ্রমিকদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনছেন না। তাঁরা শ্রমিকদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। এতে শ্রমিকেরা আরও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠছে। তারা কাউকে পরোয়া করছে না।

পরিস্থিতির উন্নতি করতে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বিভিন্ন সময় কিছু ভালো উদ্যোগ নিয়েছেন। উদ্যোগ নিয়েই মালিক-শ্রমিকদের চাপে আবার তা স্থগিত করেছেন। সরকার তাদের কাছে বারবার পরাজিত হয়েছে। এর খেসারত আমাদের দিতে হচ্ছে।

সড়ক নিরাপদ করার বহু সুপারিশ অনেক বছর ধরে দিয়ে আসছি। আরও অনেকে অনেক ধরনের সুপারিশ করেছেন। কোনো সুপারিশ কেউ শুনছে না। 

নূর নাহার ইয়াসমিন, প্রিন্সিপাল, শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজ
নূর নাহার ইয়াসমিন, প্রিন্সিপাল, শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজ

শুধু চাই সড়ক নিরাপদ হোক
নূর নাহার ইয়াসমিন, প্রিন্সিপাল, শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজ

আমি শুধু চাই, সড়ক নিরাপদ হোক। নিরাপদ সড়কের জন্য শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো পূরণ হোক। যে দুজন শিক্ষার্থী মারা গেছে, তারা আমার সন্তানের মতো। বাংলাদেশের প্রত্যেক শিক্ষার্থী আমার সন্তান। সন্তানকে স্কুল-কলেজে পাঠিয়ে দুশ্চিন্তায় যেন বাবা-মায়ের দিন না কাটে, আমি সেই নিশ্চয়তা চাই।