ক্ষুদ্র শিল্পে নারী শ্রমিকের বঞ্চনা প্রকট

পুরান ঢাকার ইসলামবাগের সরু গলির জুতার কারখানাটি ধুলা-ময়লায় ভরা। ১০ ফুট বাই ১২ ফুটের কারখানাটিতে কোনো জানালা নেই। একদিকে পুরোনো জুতার স্তূপ, অন্যদিকে দুপুরবেলাও বাতির আলোয় জুতা বাছাই ও পরিষ্কারের কাজ করছেন চার শ্রমিক। তাঁদের মধ্যে ৪২ বছরের একজন নারী শ্রমিকও আছেন। দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে সপ্তাহান্তে তাঁর আয় দেড় হাজার টাকা। একই কাজে তাঁর পুরুষ সহকর্মীর আয় প্রায় তিন গুণ।

শুধু এই নারী নন, ক্ষুদ্র শিল্পকারখানাগুলোর নারী শ্রমিকদের কম-বেশি একই রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কর্মঘণ্টা এবং কাজের দক্ষতা কাছাকাছি হওয়ার পরও পুরুষ শ্রমিকদের বেতন নারীদের প্রায় তিন গুণ। কারখানাগুলোতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদেও নেই নারীরা। পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে হয়রানি, নিপীড়নের ঘটনাও ঘটে।

রাজধানীর পুরান ঢাকার ইসলামবাগের জুতা, কামরাঙ্গীরচরের কয়লাঘাট এলাকার পলিথিন ও প্লাস্টিক—এই তিন ধরনের ১৭টি কারখানার ৩০ জন নারী শ্রমিকের সাক্ষাৎকার থেকে পাওয়া তথ্যে মজুরিবৈষম্যের এই চিত্র উঠে এসেছে। এই নারীদের বয়স ১৭ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে। এ ছাড়া পাঁচজন পুরুষ শ্রমিক, চারজন কারখানামালিক ও তিনজন নারী শ্রমিকের স্বামীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। গত মার্চ ও এপ্রিল মাসে তাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।

পোশাক কারখানায় নারী শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্য নিয়ে কাজ করেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক জ্যেষ্ঠ গবেষক প্রতিমা পাল মজুমদার। তিনি বলেন, তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য বড় কারখানায় নারী শ্রমিকদের মাসিক ভিত্তিতে নিয়োগ এবং মজুরি দেওয়া হয়। একই পদে থাকা নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমান বেতন পান। মাতৃত্বকালীন ছুটি থাকে। কিন্তু ক্ষুদ্র কারখানায় নারী শ্রমিকেরা সব দিক থেকেই বঞ্চিত।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) দেওয়া তথ্যমতে, ঢাকা মহানগরীতে ১০ হাজার ৯০০ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প রয়েছে, যার বেশির ভাগই ইসলামবাগ, কামালবাগ, শহীদনগর, হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচরে। এ শ্রম খাতে ৩১ হাজার ৯০০ মানুষ জড়িত, যাঁদের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি, ১৮ হাজার।

কারখানাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, পুরোনো জুতা ও পলিথিন বাছাই, ময়লা পরিষ্কার এবং সেগুলো ছোট ছোট করে টুকরো করার কাজ করেন নারী শ্রমিকেরা। আর প্লাস্টিক বোতল তৈরির কারখানায় মূলত প্যাকেটজাতকরণের কাজ করেন নারীরা। তাঁরা সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কাজ করেন। এতে তাঁদের সপ্তাহান্তে আয় ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। এসব কারখানায় পুরুষের তুলনায় নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি।

নারী শ্রমিকেরা বলেন, কর্মঘণ্টা এক হলেও তাঁরা ভারী কাজ তেমন একটা করতে পারেন না। এই কারণ দেখিয়েই পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কম বেতনে তাঁদের দিনভর খাটিয়ে নেন কারখানার মালিকেরা। তাঁদের অন্যত্র কাজের সুযোগও কম। ঘরেও তাঁদের গঞ্জনা সইতে হয়। নারীরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বামীরা কাজ করা ছেড়ে দেন। নারীদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।

এ বিষয়ে জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসি সুলতানা বলেন, নারীরা আয় করছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের ক্ষমতায়ন হচ্ছে না। তাঁরা পারিবারিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। আবার নারীরা অর্থনৈতিক কাজে যুক্ত হলে পুরুষেরা কর্মক্ষেত্রে অনিয়মিত হয়ে যাচ্ছেন। অর্থাৎ তাঁরা জীবনকে এখনো খেয়ে-পরে বাঁচার মধ্যেই আটকে রাখেন।

কামরাঙ্গীরচরের পলিথিন কারখানার মালিক জুলহাস মিয়া বলেন, ‘মহিলাগো যে বেতন দেব, তাতেই কাজ করবে। পুরুষদের কম দিলে অন্য কাজে চলে যাবে। তয় মহিলারা মাল টানার কাজ পারে না।’

সাত বছর আগে এক নারী শ্রমিক (৩৭) সাপ্তাহিক এক হাজার টাকায় ইসলামবাগের একটি জুতার কারখানায় কাজ নেন। তিনি শুরু থেকে একই ধরনের কাজ করে আসছেন। বছরে ৫০ বা ১০০ টাকা বেড়ে বেতন দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬০০ টাকা। অথচ একই সময়ে একই কাজে যোগ দিয়ে তাঁর পুরুষ সহকর্মী এখন ফোরম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন, যাঁর মাসিক আয় ১৬ হাজার টাকা। এই নারী বলেন, ‘যতই কাম পারুক, নারীগো প্রমোশন হয় না। তাগো ধুলা-ময়লার (নীচ) কাম আজীবন কইরা যাইতে হয়।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) যুগ্ম মহাসচিব ওয়াজেদ-উল ইসলাম খান বলেন, কর্মস্থলে নারীদের মজুরিবৈষম্য সমাজব্যবস্থা এবং মালিকদের মানসিকতার ফল। নারীদের কর্মসংস্থানের ঘাটতিও একটা বড় বিষয়। এতে তাঁরা ন্যায্য পারিশ্রমিকের জন্য কথা বলতে পারেন না। তবে সরকারের সদিচ্ছা এবং শ্রম আইন মেনে চললে এ সমস্যা দূর করা সম্ভব।

কারখানায় কোনো ওভারটাইম নেই। ছুটির দিনের বাইরে অনুপস্থিত থাকলে বেতন কাটা হয়। কামরাঙ্গীরচরের পলিথিন কারখানার এক নারী শ্রমিক জ্বরে ভুগে চার দিন কাজে আসতে পারেননি। মালিক এ কদিনের জন্য কোনো মজুরি পরিশোধ করেননি। মাতৃত্বকালীন ছুটিও নেই। মালিক জুলহাস মিয়া বলেন, ‘ছোট ব্যবসা। কাজ না করলে বেতন দেওয়া সম্ভব নয়। আর এটাই কারখানার নিয়ম।’

নারী শ্রমিকেরা জানান, তাঁরা মালিক বা সহকর্মীর হাতে নিপীড়নের শিকার হন। কর্মস্থলে যৌন হয়রানি এড়াতে মাস তিনেক আগে কামরাঙ্গীরচরের একটি পলিথিন কারখানায় কাজ নিয়েছেন এক নারী (৩৫)। আগে এই নারী ইসলামবাগে কাজ করতেন। এই নারী শ্রমিক বলেন, ‘চাকরি বদলায়ে সপ্তায় আমার আয় কমছে চাইর শ টাহা। এইহানে ধুলা-ময়লা, গরম আরও বেশি।’

এ ছাড়া অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করায় এবং শৌচাগার ব্যবহারের সুযোগ কম থাকায় চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, কাশি, প্রস্রাবের সমস্যায় ভুগে থাকেন কর্মজীবী এই নারীরা। ইসলামবাগ নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক জিনাত ফওজিয়া রোজালীন বলেন, কারখানার নারী শ্রমিকেরা মূলত প্রজনন অঙ্গে সংক্রমণ, প্রস্রাবে সংক্রমণ, সাদা স্রাব ও চর্ম সমস্যা নিয়ে আসেন। এর মূল কারণ তাঁরা দীর্ঘ সময় নোংরা পরিবেশের মধ্যে থাকেন।