বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে ঢাকা

দেশের মোট আয়তনের ১ শতাংশ ঢাকা মহানগর। আর এখানে বাস করে দেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ। প্রথম আলো ফাইল ছবি
দেশের মোট আয়তনের ১ শতাংশ ঢাকা মহানগর। আর এখানে বাস করে দেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ। প্রথম আলো ফাইল ছবি

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯০ শতাংশ ওয়ার্ডেই ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি মানুষ বাস করে। অতিরিক্ত মানুষের চাপেই রাস্তায় যানজট, নাগরিক পরিষেবার অবনতিসহ জীবনযাত্রার মান ক্রমেই নিচে নামছে। ফলে ক্রমেই বসবাসযোগ্যতা হারাচ্ছে এই শহর।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাউজক) প্রক্রিয়াধীন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) অংশ হিসেবে করা এক সমীক্ষায় ও নগর পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

নগরবিদদের মতে, ঢাকামুখী মানুষের স্রোত বৃদ্ধি ও ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে অতিরিক্ত মানুষের অবস্থান তৈরিতে সাহায্য করেছে বর্তমান ইমরাত নির্মাণ বিধিমালা। এই বিধিমালায় বাস্তবতার কথা চিন্তা না করে ভবন উঁচু করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রতিটি ভবনে বসবাসের জায়গা বেড়েছে। আর জায়গা পাওয়ায় মানুষও ঠাসাঠাসি করে থাকছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমাজের সবখানে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী পূর্বাচল নতুন শহরে বাড়ি করার সুযোগ দিলে সেই শহরও ভেঙে পড়বে।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর ঢাকার জনসংখ্যা ৩-৪ শতাংশ হারে বাড়ছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, দেশের মোট আয়তনের ১ শতাংশ ঢাকা মহানগর। আর এখানে বাস করে দেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ।

ড্যাপের সমীক্ষা অনুযায়ী, ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে। উত্তর সিটি করপোরেশনে বেশি লোকের বাস ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে।

ডিএসসিসির তথ্য অনুযায়ী, পুরান ঢাকার মিল ব্যারাক অ্যান্ড পুলিশ লাইন, কেশব ব্যানার্জী রোডের একাংশ, অক্ষয় দাস লেন, শাঁখারী নগর লেন, হরিচরণ রায় রোডের একাংশ, আলমগঞ্জ রোড, সতীশ সরকার রোড ও ঢালকানগর লেনের একাংশ নিয়ে ডিএসসিসির ৪৬ নম্বর ওয়ার্ড। এর আয়তন মাত্র শূন্য দশমিক ৫১৪ বর্গ একর। রাজউকের সমীক্ষা বলছে, এই এলাকার জনঘনত্ব একরপ্রতি ১ হাজার ৩৭৯ জন। ধারণক্ষমতার চাইতে এখানে ৯ দশমিক ২ গুণ মানুষ বেশি বাস করে।

ডিএনসিসির তথ্য অনুসারে, জাফরাবাদ, উত্তর সুলতানগঞ্জ, রাজমূশুরী জাফরাবাদ, রায়েরবাজার, পূর্ব রায়েরবাজার, শংকর, মধুবাজার ও পশ্চিম ধানমন্ডি নিয়ে ডিএনসিসির ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড। এর আয়তন ১ দশমিক ৩৬২ বর্গকিলোমিটার, হোল্ডিং আছে ২ হাজার ৩৯৭টি। সমীক্ষা অনুযায়ী, এই ওয়ার্ডের জনঘনত্ব একরপ্রতি ৬৬৮ জন। এটি ওই এলাকার ধারণক্ষমতার চাইতে সাড়ে চার গুণ বেশি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ধারণক্ষমতার চাইতে বেশি মানুষ বাস করলে সেই এলাকায় গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, পানিনিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ সব ধরনের নাগরিক সেবা খাতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ঢাকার পরিবেশ নষ্ট ও চিকুনগুনিয়ার মতো রোগের প্রাদুর্ভাব যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়া অতিরিক্ত জনসংখ্যার ফল।

সরেজমিনে ডিএনসিসির ৩৪ নম্বর ও ডিএসসিসির ৪৬ নম্বর ওয়ার্ড দুটি ঘুরে দেখা গেছে, দুই ওয়ার্ডেই খেলার মাঠ বা পার্ক নেই। প্রতিটি ওয়ার্ডেই রাস্তা খুব সরু। কিছু সড়কে পাশাপাশি দুই রিকশা চলতেও কষ্ট হয়। রাস্তাঘাটও ভাঙাচোরা। বাড়িগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন একটি আরেকটির গলা জাপটে ধরে আছে। তবে পশ্চিম ধানমন্ডি এলাকার অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো।

 ডিএসসিসির ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের অবস্থা তুলনামূলকভাবে খারাপ। এই ওয়ার্ডের সতীশ সরকার রোডসহ কয়েকটি সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, এখানে রাস্তার পাশে বাড়ি বা দোকান তৈরির ক্ষেত্রে কোনো জমি ছাড় দেওয়া হয়নি। ভবনগুলোর প্রায় প্রতিটিই নালার গা ঘেঁষে তৈরি করা। নালাগুলোও উন্মুক্ত। সতীশ সরকার রোডের বেশ কয়েকটি বাড়ির সামনে ময়লার স্তূপও দেখা গেছে। নাগরিক সুযোগসুবিধাও এখানে সীমিত। গলিগুলোর অবস্থা আরও করুণ। 

এই ওয়ার্ডের টেকের গলির বাসিন্দা রবিউল হাসান বলেন, সিটি করপোরেশনের আবর্জনা সংগ্রাহকেরা নিয়মিত আসেন না। আসেন সপ্তাহে এক দিন। তাই অনেকেই রাস্তায় গৃহস্থালি আবর্জনা ফেলে রাখেন। এখানে কোনো খেলার মাঠ বা পার্ক নেই। ব্যক্তিমালিকানাধীন একখণ্ড জমিতে এলাকার শিশু-কিশোরেরা খেলাধুলা করে।

এই ওয়ার্ডের বাঘাবাড়ির গলির বাসিন্দা মো. জিতু বলেন, তাঁর এলাকায় পানির সমস্যা নেই। কিন্তু গ্যাসের সংকট তীব্র। রাত ১১-১২টার দিকে গ্যাস আসে আর যায় সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার দিকে। গ্যাসের কারণে তাদের খুব সমস্যা হয়।

এই এলাকায় দীর্ঘদিন থেকে রিকশা চালান আমজাদ আলী। তিনি বলেন, রাস্তা সরু হওয়ায় প্রায়ই যানজট লাগে। বিশেষ করে রাতে ট্রাক চলাচল শুরু হলে অন্য যানবাহন চলাচল খুব কষ্টকর হয়ে পড়ে।   

নাগরিক সেবায় বিঘ্ন ঘটা ও জনঘনত্ব বাড়ার পেছনে বর্তমান ইমারত নির্মাণ বিধিমালার দায় দেখছেন নগর পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ ফজলে রেজা। তাঁর মতে, ঢাকায় মানুষের থাকার জায়গা যত বাড়ানো হবে, মানুষও তত আসতে থাকবে। কোনো বাসাই ফাঁকা থাকবে না। ২০০৬ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় ৩০ ফুট একটি রাস্তার পাশে ৫ কাঠা জমিতে সাততলা বাড়ি বানানোর সুযোগ ছিল, বর্তমান বিধিমালায় (২০০৮ সালের) সেটি ১০ তলা পর্যন্ত করার সুযোগ হয়েছে। অর্থাৎ আগে যেখানে আনুমানিক ১৪টি পরিবার থাকতে পারত, এখন সেখানে ২২টি পরিবার থাকতে পারবে। অথচ সে তুলনায় নাগরিক সেবা বাড়েনি। ফলে অতিরিক্ত ছয় পরিবার নাগরিক সেবায় ভাগ বসালে এতে চাপ পড়বে। তিনি বলেন, জনঘনত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০০৮ সালের বিধিমালাটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রায় আট বছরেও এটি আলোর মুখ দেখেনি।

পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প সম্পর্কে এই পরিকল্পনাবিদ বলেন, প্রকল্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে ১০ লাখ মানুষের থাকার কথা। কিন্তু বর্তমান বিধিমালা অনুযায়ী পূর্বাচলে বাড়ি বানালে ৭০ লাখের বেশি মানুষ সেখানে থাকতে পারবে। ফলে নাগরিক সেবাও ভেঙে পড়বে।

জানতে চাইলে প্রক্রিয়াধীন ড্যাপের (২০১৬-২০৩৫) প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রক্রিয়াধীন ড্যাপে ‘ডেনসিটি জোনিং’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জনঘনত্ব সহনীয় রেখে কীভাবে নগরজীবন উন্নয়ন করা যায়, সে লক্ষ্যেই পরিকল্পনা করা হচ্ছে।