জীবন রক্ষার সরঞ্জাম নেই

পায়রা, বিষখালী, বলেশ্বর নদ-নদীর মোহনাসহ বঙ্গোপসাগরে বরগুনার তিন হাজারের বেশি নৌযানে করে মাছ ধরতে যান জেলেরা। এসব নৌযানে জীবন রক্ষাকারী বয়া, লাইফ জ্যাকেট, রেডিও, দিকনির্ণায়ক যন্ত্রসহ প্রয়োজনীয় ১২টি সরঞ্জাম নেই। এ কারণে প্রায়ই প্রাণহানি ঘটছে জেলেদের।

সরকারি নিয়মানুযায়ী, সমুদ্রগামী নৌযানগুলো নির্মাণের আগে মেরিন বিভাগের চট্টগ্রাম কার্যালয় থেকে নকশা অনুমোদন নিয়ে নিবন্ধন করাতে হয়। তা ছাড়া নৌযানে জীবন রক্ষাকারী ১৩টি প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম থাকতে হয়।     

তবে জেলেরা বলছেন, উপকূলীয় জেলা বরগুনাসহ এ অঞ্চল থেকে বঙ্গোপসাগরে চলাচলকারী বেশির ভাগ নৌযানের নকশার অনুমোদন ও সরকার নির্ধারিত প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই। এ কারণে বরগুনায় ছোট-বড় প্রায় ৩ হাজার ট্রলারের ৪৫ হাজার জেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন মাছ ধরতে যাচ্ছেন। এতে স্থানীয়ভাবে তৈরি নাজুক এসব ট্রলার সাগর ও নদীতে দমকা হাওয়ায় ও ঝড়ের মুখে পড়ে প্রায়ই ডুবে যাচ্ছে। ঘটছে প্রাণহানি।

জানতে চাইলে পাথরঘাটা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. হুমায়ুন কবির বলেন, মাছ ধরা ট্রলারে ১৩টি জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম নিশ্চিত করা গেলে সাগরে হতাহতের পরিমাণ কমে আসবে।

গত ২১ জুলাই বরগুনা সদর ও পাথরঘাটা উপজেলার ৮টি ট্রলারের ৬৫ জন জেলে বঙ্গোপসাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে নিখোঁজ হন। ২৭ জুলাই সকালে দুবলারচর, মান্দারবাড়িয়া, আলোরকোল এলাকা থেকে চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরদিন সন্ধ্যায় সাগরে ভাসমান অবস্থায় তিনজনকে জীবিত উদ্ধার করেন জেলেরা। অন্যদের সলিলসমাধি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

উদ্ধার হওয়া জেলে মনির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ২১ জুলাই সকাল ১০টার দিকে ঝড়ের কবলে পড়ে এফবি শাহজালাল ট্রলার উল্টে যায়। এ সময় তিনিসহ ট্রলারের ১৯ জন জেলে সাগরে ঝাঁপ দেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই হাতে ফ্লোট (জাল ভাসিয়ে রাখার বস্তু) নিয়ে ট্রলারের ওপর ভাসতে থাকেন। সাগরে ভাসার পর তিনিসহ তিনজন উদ্ধার হলেও বাকি ১৬ জেলের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁরা মারা গেছেন।

জেলা ট্রলার মালিক সমিতির তথ্যানুযায়ী গত ২০ বছরে এ অঞ্চলে ট্রলারডুবিতে কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার জেলে মারা গেছেন। নিখোঁজ হয়েছেন
কমপক্ষে ১০ হাজার। চট্টগ্রামে অবস্থিত মেরিন সদর দপ্তর থেকে সারা দেশের জেলেদের নিবন্ধন, ট্রলারের নকশা অনুমোদন, নিবন্ধন হালনাগাদ করণসহ
যাবতীয় কাজ পরিচালিত হয়। অনেক ট্রলার নিবন্ধনহীন থাকায় প্রাণহানির সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। অন্তত প্রাণহানির তথ্যগুলো উপজেলা মৎস্য দপ্তরে থাকা দরকার।

জেলা ট্রলার মালিক সমিতির নেতারা বলেন, দক্ষিণের জেলা বরগুনা দ্বিতীয় মৎস্য বন্দর হিসেবে পরিচিত হলেও এ জেলায় মেরিন বিভাগের কোনো শাখা কার্যালয় নেই। জেলেদের নিবন্ধন, নকশা অনুমোদন ও নিবন্ধন হালনাগাদের জন্য প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার দূরত্বের চট্টগ্রামে অবস্থিত মেরিন সদর দপ্তর যেতে হয়। এসব কারণে মাছ ধরা ট্রলার ফিটনেস ও নিবন্ধনবিহীন থেকে যায়।

জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘ট্রলারে ১৩টি জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম খুবই প্রয়োজন। এসব প্রয়োজন আমরা আগে এতটা অনুভব করিনি। তবে এখন থেকে সমিতির ট্রলারগুলোয় এসব সরঞ্জাম আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে। পাথরঘাটায় মেরিন বিভাগের একটি কার্যালয় করা হলে ট্রলার নিবন্ধনে আরও সহজ হবে।’ তিনি আরও বলেন, বঙ্গোপসাগর ও এর মোহনা এবং উপকূল এলাকায় সংকেতবাতি, প্রতিটি থানায় ও কোস্টগার্ড ঘাঁটিতে ট্রলার উদ্ধারকারী যান এবং সাগরের যেকোনো ঘটনায় তীরবর্তী থানায় মামলা করার দাবি জানান।

১৫টি ট্রলারে গিয়ে ও জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বয়া, দিকনির্ণায়ক যন্ত্র, বাতিসহ বেশির ভাগ ট্রলারে জীবন রক্ষাকারী ১৩টি সরঞ্জাম থাকে না। উপকূলীয় এলাকার ট্রলারের মধ্যে ৯০ ভাগ ট্রলারে বয়া ও লাইফ জ্যাকেট এবং ৯৯ ভাগ ট্রলারেই দিকনির্ণায়ক যন্ত্র নেই। যে ১০ ভাগ ট্রলারে বয়া ও লাইফ জ্যাকেট থাকে, তারও সংখ্যা ২ থেকে ৩।

জেলেদের নিয়ে কাজ করে, এমন একটি বেসরকারি সংস্থা সুশীলন। সংস্থাটির পাথরঘাটা উপজেলা ব্যবস্থাপক ইসমাইল হোসেন বলেন, বেশির ভাগ ট্রলারেই ১৩টি জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম থাকে না। এসব সরঞ্জাম নিশ্চিত করা গেলে গভীর সাগরে নিরাপদে মৎস্য আহরণ সম্ভব। এতে জেলেসহ মৎস্যজীবীরা সরকারের জিডিপি বৃদ্ধিতে ব্যাপকভাবে ভূমিকা রাখবেন। তা ছাড়া মাছ ধরা ট্রলারে বিমাও বাধ্যতামূলক থাকা আবশ্যক।

জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. মোখলেছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাছ ধরা ট্রলারের জেলেদের জীবন রক্ষার জন্য লাইফ জ্যাকেট, বয়া, রেডিও ও এক ট্রলার থেকে আরেক ট্রলারে যোগাযোগের জন্য ওয়াকিটকিসহ অন্য সব সরঞ্জাম দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করব। এ ছাড়া ট্রলারগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধন করানো হবে।’