কামরানের হারে লাভ দেখছে আ.লীগ!

নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার অনুষ্ঠানে বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। প্রথম আলো ফাইল ছবি
নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার অনুষ্ঠানে বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। প্রথম আলো ফাইল ছবি

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় মেয়রপ্রার্থী হারবেন—এমনটা ভাবেননি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। আবার বরিশালে হঠাৎ করেই বিএনপির প্রার্থী কোনো প্রতিরোধ ছাড়া হাল ছেড়ে দেবেন, তাও ভাবেনি শাসক দল। তবে সিলেটে দলীয় প্রার্থী হারায় লাভই দেখছেন তাঁরা। অন্যদিকে, বরিশালে বিএনপির প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করার আগে চার ঘণ্টায় মাত্র ১৩ হাজার ভোট পাবেন—এমনটাও ভাবেননি তাঁরা।

শাসক দলের সভাপতিমণ্ডলীর দুই সদস্য, একজন যুগ্ম সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক এবং দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলেন—এমন কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব জানান গেছে।

গত ৩০ জুলাই শেষ হওয়া তিন সিটির নির্বাচনে রাজশাহী ও বরিশালে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীরা জেতেন। সিলেটে ১৩৪টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৩২টি কেন্দ্রে প্রায় চার হাজার ভোট বেশি পেয়ে নিশ্চিত বিজয়ের পথেই ছিলেন বিএনপির প্রার্থী। দুটি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত হওয়ায় তাঁকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়নি। গতকাল শনিবার স্থগিত হয়ে যাওয়া দুই কেন্দ্রে ভোট নেওয়া হয়। এতে আরিফুল হক চৌধুরী ৯২ হাজার ৫৯৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। আওয়ামী লীগের কামরান পেয়েছেন ৮৬ হাজার ৩৯৭ ভোট।

জয় পাওয়া দুই সিটির চেয়ে হারানো সিলেট নিয়ে শাসক দলে এখন আলোচনা বেশি।

সিলেটে দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল বলে স্বীকার করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। তিনি বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ কিছু কোন্দল ছিল। দল একতাবদ্ধ হয়ে কাজও হয়তো করতে পারেনি। এ ছাড়া সেখানে স্থানীয় কিছু ইস্যু ছিল, যা আমরা অ্যাড্রেস (মোকাবিলা) করতে পারিনি।’

সিলেটে বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করার পেছনে ‘আর কোনো বিকল্প’ না পাওয়াই মূল কারণ। দলটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য এ কথা বলেন। কামরানকে নিয়ে দলের মধ্যে ক্ষোভ ছিল বলেও জানান তিনি। তবে দলের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে থাকা, আগের অভিজ্ঞতা—এসব নানা বিবেচনায় কামরানকে প্রার্থী করা হয়। তবে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল শেষতক নিরসন হয়নি।

দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কোন্দলের কারণে সাতটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী পর্যন্ত দেওয়া যায়নি। পরিস্থিতি তাহলে কী ছিল তা বোঝা যায়।’

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কয়েকটি বিষয় বোঝানো হয়েছিল প্রার্থীর জয়ের ক্ষেত্রে ইতিবাচক দিক হিসেবে। এক, বিএনপি তার সর্বশক্তি দিয়ে নির্বাচনে আসতে পারবে না। দলের বিদ্রোহী প্রার্থী নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিমের প্রার্থী হওয়ায় আরিফুলের অবস্থা নাজুক হবে। তবে নির্বাচনের কদিন আগে বদরুজ্জামান সেলিম তাঁর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলে শাসক দলের সেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়।

দুই, বিএনপির জোটসঙ্গী জামায়াতের প্রার্থী হওয়াকেও ইতিবাচক বলে জানায় সিলেট আওয়ামী লীগ।

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য এবং দলের নির্বাচনী কাজে ছিলেন—এমন এক নেতা বলেন, ‘স্থানীয় জামায়াতের কিছু ভোট আওয়ামী লীগের পক্ষে আসতে পারে বলে আমাদের নিশ্চিত করা হয়েছিল। বাস্তবে তা কখনো হবে না বলে আমার বিশ্বাস ছিল। জামায়াতের ভোট নৌকায় পড়বে, তা অবিশ্বাস্য।’

স্থানীয় জামায়াতে ২৫ হাজারের মতো ভোট আছে বলে নির্বাচনের আগে চাউর হয়েছিল। নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থী এবং দলটির নগরের আমির এহসানুল মাহবুব জুবায়ের পেয়েছেন ১০ হাজার ৯৫৪ ভোট। বাকি ভোট কোথায় গেল? আওয়ামী লীগের ওই নেতা বলেন, ‘জামায়াতের ভোট আরিফুলের বাক্সেই গেছে। নৌকায় একটিও আসেনি।’

শাসক দল হওয়ার কারণে ‘প্রশাসনিক সুবিধা’র পাশাপাশি সাংগঠনিক সবলতা ছিল বলেই খুলনা ও গাজীপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন বলে দলটির নেতারা মনে করেন। রাজশাহীতে দলটি তাদের একতা ধরে রেখেছিল। বরিশালেও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর কারণে দলটির ঐক্য দৃশ্যত অটুট থেকেছে। কিন্তু সিলেটে সেই অবস্থা ছিল না। তবে সেই নির্বাচনে হেরে দলের ক্ষতি হয়নি বলেই মনে করে দলটি।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘সিলেটে কাঙ্ক্ষিত ঐক্য ছিল না, এটা ঠিক। তবে সেখানকার দুর্বলতাগুলো আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি। এটা একটা ভালো ইঙ্গিত। এখন জাতীয় নির্বাচনের জন্য ছক কষা সহজ হবে। এটা শেষতক আমাদের জন্য ভালোই হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, সিলেটে একটি বড় দিক, সেখানে আমাদের ভোট আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। তাই আমাদের অবস্থান খারাপ হয়নি।’

২০১৩ সালের মেয়র নির্বাচনে ২০-দলীয় জোটের সমর্থন নিয়ে আরিফুল হক চৌধুরী ৩৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছিলেন আওয়ামী লীগের কামরানকে। এবার ভোটের ব্যবধান ছয় হাজার।

আওয়ামী লীগ মনে করে, রাজশাহী, বরিশাল ও খুলনায় ২০০৮ সালে নির্বাচিত দলীয় মেয়র প্রার্থীদের একটা সুখ্যাতি আছে। তাঁদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণেই একটা ভালো ইমেজ ছিল এবারের নির্বাচনে। এসব সিটিতে ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে তেমন উন্নয়নকাজ করতে পারেননি। তাই এসব জায়গায় এবারের প্রার্থীদের একটা ‘সুবিধা’ ছিল। কিন্তু তিন সিটির বিএনপির মেয়ররা পর্যাপ্ত কাজ না করতে পারলেও সিলেটের পরিস্থিতি তেমন ছিল না।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘গত কয়েক বছরে সিলেটে আমাদের অর্থমন্ত্রী ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ করেছেন। এর বেশির ভাগই হয়েছে সিলেট সিটিতে। আর এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী সিলেটের সিটি মেয়রকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। এতে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে এমন ধারণার সৃষ্টি হয়েছে—এসবের ভাগীদার আরিফুল হক। আর নির্বাচনে এর প্রতিফলন ঘটেছে।’

শাসক দলের প্রার্থীরা না থাকলে ‘উন্নয়ন’ হবে না, তাই আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে হবে—এখন এমন একটি মনোভাব জনমনে পোক্ত বলেই মনে করে আওয়ামী লীগ। তাদের ধারণা, সিলেটে যেহেতু কিছু দৃশ্যমান উন্নয়ন দেখেছে, সে ক্ষেত্রে তারা পদে থাকা মেয়র আরিফুল হককে বেছে নিয়েছে। কামরান মেয়র থাকার সময়ের ব্যাপক ‘উন্নয়নের স্মৃতি’ তাদের নেই।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষের চাওয়া যে উন্নয়ন, সিলেটের নির্বাচনে তা প্রমাণিত হয়েছে। এই উন্নয়ন আমাদের কাজের ফসল।’

শাসক দল মনে করে, খুলনা ও গাজীপুরের নির্বাচনের পর বিরোধী দলগুলোর পাশাপাশি দেশের সুশীল সমাজের একটি অংশ এবং বিদেশিরাও এসব নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ধরেন। সিলেটে নির্বাচনে বিএনপি জেতার পর তাদের সেই বক্তব্য আর যৌক্তিকতা পাবে না। এটা তাদের জন্য ভালোই হয়েছে।

ফারুক খান বলেন, ‘কোনো সিটিতে আমরা জিতলে সেটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আর বিএনপি জিতলে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকে না। দুই সিটিতে আমাদের বিজয়ের পর এসব প্রচারণা বেশি হয়। কিন্তু সিলেটে প্রমাণিত হলো, আমরা কখনোই অগণতান্ত্রিক আচরণ করিনি। সমালোচনাকারীরা নিশ্চয়ই তাদের জবাব পেয়েছে।’

সিলেটে হেরে আওয়ামী লীগ যেভাবে লাভ দেখছে, তা কি হেরে যাওয়ার পর সান্ত্বনা, নাকি এর যৌক্তিকতা আছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার মনে করেন, আওয়ামী লীগের এই লাভ দেখায় যৌক্তিকতা আছে। তিনি এও মনে করেন, এখানে লাভের পাশাপাশি আসলে হয়েছে ‘শিক্ষা’। সেটা কেমন? আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি সম্পন্ন করা এই শিক্ষক মনে করেন, জামায়াতের ভোট যে নৌকার বাক্সে পড়ে না, এই শিক্ষা তাদের নিতে হবে। শান্তনু মজুমদার বলেন, এবার বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদন দেখে স্থানীয় আওয়ামী লীগের জামায়াতের সঙ্গে একধরনের বোঝাপড়ার বিষয়টি জানা গিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি এবং হবেও না—এই শিক্ষাটা শাসক দলকে নিতে হবে। তিনি বলেন, অতীতে একাধিকবার রাজনৈতিক কৌশলে জামায়াতকে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু তাদের ভোট পায়নি। তা তারা পাবেও না।

‘শিক্ষা’র পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে সিলেটের ফলাফল আওয়ামী লীগকে কিছু সুবিধা দিয়েছে বলেও মনে করেন শান্তনু মজুমদার। তিনি বলেন, যৌক্তিক কারণেই যারা আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেন, সিলেটের ফলে তারা হয়তো হোঁচট খাবেন। এটা জাতীয় নির্বাচনে দলটিকে সুবিধা দিতে পারে।