মুক্তির মন্ত্রদাতা, স্বাধীনতার মন্ত্রণাদাতা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।  ছবি: সংগৃহীত
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

একটা রাষ্ট্র যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি যে এমনভাবে ঘাতকের অস্ত্রাঘাতে নিহত হবেন, কেউ কি কখনো তা ভেবেছিল? প্রবল আত্মবিশ্বাস আর দেশবাসীর প্রতি আস্থা হয়েছিল তাঁর কাল। কিন্তু সেই আত্মবিশ্বাস, সেই আস্থা, সেই ভালোবাসাই কি তাঁর গুণ ছিল না? তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুকে অতিক্রম করে তাঁর গৌরবোজ্জ্বল জীবনের দিকে আজ যখন তাকাই, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত গুণ ও বৈশিষ্ট্য এবং তাঁর রাজনৈতিক লক্ষ্য ও কর্মপন্থা আমাদের অভিভূত করে।

বঙ্গবন্ধুর প্রথম যে গুণ আমরা লক্ষ করি, তা তাঁর অদম্য সাহস। অল্প বয়সে এক মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে ফৌজদারি মামলার আসামি হতে হয়েছিল তাঁকে। মুরব্বিদের কেউ তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন দু-একটা দিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে। তিনি সম্মত হননি। বলেছিলেন, ওরা বলবে আমি পালিয়ে গেছি। ফলে তিনি গ্রেপ্তার হন, নিক্ষিপ্ত হন থানা-হাজতে। এর অনেক দিন পরে, পাকিস্তান সরকার যখন পূর্ব বাংলায় নির্বাচিত মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে কেন্দ্রের শাসন জারি করে, তখন সদ্য মন্ত্রিত্ব-হারানো শেখ মুজিবের বাসভবনে পুলিশ হানা দেয় এবং তাঁকে না পেয়ে চলে যায়। ঘরে ফিরে এসে তিনি সে-খবর পান। তৎক্ষণাৎ ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে ফোন করেন তিনি: আপনার ফোর্স আমার বাসায় এসেছিল বোধহয় আমাকে অ্যারেস্ট করতে। তাদের পাঠিয়ে দেন, আমি এখন বাসায়। আত্মগোপনকারী বাম রাজনীতিবিদদের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও তিনি আত্মগোপনের রাজনীতি নিজের বলে মনে করেননি। তাই আশ্চর্য নয় যে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তিনি রয়ে যান ধানমন্ডির বাড়িতে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সুযোগ দেন তাঁকে গ্রেপ্তার করতে।

এই অসীম সাহসের আরেক পরিচয়স্থল তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ। সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ করতে প্রস্তুত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মারণাস্ত্রের মুখে দাঁড়িয়ে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলতে অসামান্য সাহসের প্রয়োজন হয়। সে-সাহস তাঁর ছিল। অবশ্য সেই সাহসের অনেকটাই তিনি সংগ্রহ করেছিলেন অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মানুষের তেজোদীপ্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ থেকে।

তাঁর আরেকটি গুণ ছিল একাগ্রচিত্ততা। যখন মুসলিম লীগের রাজনীতি করেছেন, তখন পাকিস্তানের দাবিতে ছিলেন অবিচল। যখন বাঙালির স্বাধিকার-প্রতিষ্ঠাকে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করলেন, তখন মুসলিম লীগ ত্যাগ করতে একটুও ইতস্তত করেননি। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে প্রথম কারাবরণ করেন তিনি। তারপর কতবার যে কারাগারে গেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। কোনো দমন-পীড়ন তাঁকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি। প্রথম জীবনে নেতা মেনেছিলেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীকে। গুরুর সঙ্গে কখনো কখনো মতানৈক্য ঘটা সত্ত্বেও শেষ অবধি তাঁকেই নেতা বলে মান্য করেছেন। মওলানা ভাসানীর মধ্যে উদারতার অভাব লক্ষ করেও তাঁর নেতৃত্বাধীনে রাজনীতি করেছেন-যত দিন না মওলানা নিজে অন্য রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন।

বাঙালিত্বের গৌরবও তাঁর মধ্যে ছিল অপরিমেয়। রবীন্দ্রনাথের গান ও নজরুলের কবিতা তাঁর কণ্ঠে বারংবার ধ্বনিত হয়েছে, আব্বাসউদ্দীনের গান ছিল তাঁর অতি প্রিয়। বাঙালির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যেই ছিল তাঁর সংগ্রাম। নিতান্ত প্রতিকূল পরিবেশে ১৯৬৬ সালে তিনি উপস্থাপন করেন ‘আমাদের বাঁচার দাবি-৬ দফা কর্মসূচি’। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দী অবস্থায় সামরিক প্রহরার মধ্যেও দেশের মাটির ধুলো মাথায় নিয়ে বলেছিলেন, এখন তিনি মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত। ১৯৬৯ সালে পূর্ব বাংলাকে আখ্যায়িত করেছিলেন বাংলাদেশ বলে এবং দেশবাসীর রক্তের সঙ্গে বেইমানি করবেন না বলে ওয়াদা করেছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বেন। এসব কথা তিনি রেখেছিলেন, কোনো আপস করেননি। ক্ষমতার হাতছানি তাঁকে অভিভূত করেনি, মৃত্যুভয় তাঁকে বিচলিত করেনি। ১৯৭১ সালে যখন তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী, তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষিত হয়ে গেছে, তাঁর কারা-প্রকোষ্ঠের সামনেই খনন করা হচ্ছে তাঁর কবর, তখন তিনি একটিমাত্র ইচ্ছাই জ্ঞাপন করেছিলেন, তাঁর লাশ যেন সমাহিত করা হয় তাঁর স্বদেশে।

মনেপ্রাণে যিনি বাঙালি, তিনি যে অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন হবেন, সে-কথা স্বতঃসিদ্ধ। অল্প বয়সে ছুঁতমার্গের লক্ষ্য হওয়ায় তিনি পীড়িত হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু অভিভূত হয়েছেন মাদারীপুরের স্বদেশি নেতা পূর্ণচন্দ্রের আত্মত্যাগে। মুসলিম লীগের কর্মী হয়েও তিনি অনুরাগী হয়েছেন সুভাষ বসুর। ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে কলকাতায় তিনি বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ইসলামিয়া কলেজের অধ্যাপক ভবতোষ দত্তকে পাহারা দিয়ে মুসলমান এলাকা পার করে দিয়েছেন, আবার হিন্দু এলাকার সীমান্ত থেকে তাঁকে নিয়ে কলেজে পৌঁছে দিয়েছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর অধিকাংশ মানুষ যখন ধর্মীয় পরিচয়কে ধরে রেখেছে আত্মপর-নির্ণয়ের মানদণ্ডরূপে, তখন তিনি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রগঠনের আবশ্যকতা সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করেছেন। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে শেখ মুজিব আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি পরিহার করতে চেয়েছিলেন, তবে তাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় মওলানা ভাসানী পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রদেশে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের অনুষ্ঠান পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। নির্বাচনের পরে প্রথম সুযোগেই শেখ মুজিবের প্রয়াসে আওয়ামী মুসলিম লীগ রূপান্তরিত হয় আওয়ামী লীগে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র রচনার সময়ে দেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র আখ্যা দেওয়ার প্রতিবাদ করেছিলেন শেখ মুজিব এবং পূর্ব বাংলার জন্য যুক্ত নির্বাচনপ্রথা প্রবর্তনের সুপারিশ করতে সফল প্রয়াস নিয়েছিলেন। ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিরোধে তাঁকে দেখেছি ট্রাকে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে ঢাকা শহর পরিক্রম করতে। সবশেষে ধর্মনিরপেক্ষতাকে তিনি রূপ দিয়েছিলেন বাংলাদেশে রাষ্ট্রপরিচালনার একটি মূলনীতিরূপে।

এ থেকে চলে আসে সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রপরিচালনার আরেকটি মূলনীতি সমাজতন্ত্রের কথা। আমরা জানি, মুসলিম লীগের কর্মী হিসেবে মুজিব ছিলেন সোহ্রাওয়ার্দী-আবুল হাশিম উপদলের অন্তর্ভুক্ত। আবুল হাশিমের চিন্তাধারা হয়তো একটি ন্যায়পরায়ণ সমাজগঠনে তাঁকে প্রেরণা দিয়েছিল। তবে ১৯৫৬ সালের চীন ভ্রমণের পর সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহের সৃষ্টি হয়। তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা যতই সমৃদ্ধ হয়েছে, ততই তিনি সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছিলেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্র থেকে তিনি দূর করতে চেয়েছিলেন সকল প্রকার শোষণ-বঞ্চনা। তবে তা বাস্তবায়নের সময় তিনি পাননি।

দেশের মানুষকে তিনি ভালোবেসেছিলেন এবং বড় বেশি ভালোবেসেছিলেন। দেশের মানুষও তাঁকে ভালোবেসেছিল-আজও ভালোবাসে। তার কারণ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্থপতি। আরও কারণ, সাধারণ মানুষ তাঁকে নিজেদের একজন মনে করেছে। বঙ্গবন্ধু বহু মানুষকে এবং তাদের পিতা বা পুত্রকে মনে রাখতে পারতেন। এ ক্ষমতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের ছিল, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ছিল, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর প্রজন্মের আর কারও ছিল না। এই ‘আমাদের লোক’কে মানুষ ভোলেনি, ভুলবে না। দেশদ্রোহী ঘাতকেরা ভেবেছিল, সপরিবারে শেখ মুজিবকে হত্যা করে তাঁকে এবং তাঁর রাজনৈতিক ভাবধারাকে মুছে ফেলা যাবে ইতিহাসের পাতা থেকে। তাদের প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের কাছে বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছেন জ্যোতির্ময় হয়ে, চিরজীবী হয়ে।