স্বজনদের আহাজারি, নিরাপত্তা না দিলে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাবেন না

রাজশাহীতে দোকানে বাস ঢুকে তিনজন নিহত হওয়ার পর নিহত স্কুলছাত্রীর স্বজনেরা আহাজারি করে বলছেন, সড়কে নিরাপত্তা না দিলে ছেলেমেয়েদের আর স্কুলে পাঠাবেন না। তাঁরা ঘাতক বাসচালকের উপযুক্ত বিচার চান। 

বুধবার দুপুরে হাসপাতালে নেওয়ার পর নওহাটা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী আনিকার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরে তার খালা আহাজারি করে এসব কথা বলছিলেন। এ সময় নির্বাক ছিলেন আনিকার মা।

আজ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজশাহী নগরের নওদাপাড়া এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।

অভিযোগ উঠেছে, ওই বাসে চালকের আসনে ছিলেন তাঁর সহকারী। ট্রাফিক সপ্তাহ শেষ হওয়ার পরদিনই এভাবে বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দোকানের ভেতরে ঢুকে তিনজনের প্রাণহানির ঘটনায় এলাকার ছাত্র ও জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁরা নগরের আমচত্বর এলাকায় একটি ট্রাক, একটি বাস ও দুটি ভটভটি ভাঙচুর করেন। এরপর গাড়ির কাগজপত্র যাচাই করে।

নিহত স্কুলছাত্রীর নাম আনিকা (১৩)। নিহত অপর দুই ব্যক্তির নাম সাখাওয়াত হোসেন খান ওরফে সবুজ (৩২) ও ইসমাইল হোসেন (৩০)। বাসটির নাম ‘অ্যারো বেঙ্গল’। এটি রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের মধ্যে যাতায়াত করে। বাসাটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসে। সূত্র জানিয়েছে, নগরের বর্ণালীর মোড় এলাকায় এসে চালক বাস থেকে নেমে যান। যাত্রীরা সব নগরের কামারুজ্জামান চত্বরে নেমে যায়। খালি গাড়িটি চালকের সহকারী নগরের নওদাপাড়া বাস টার্মিনালে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তার নাম পাওয়া যায়নি। চালকের নাম জনি বলে জানা গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা জানান, বাসটি প্রথমে নগরের নওদাপাড়া এলাকায় পোস্টাল একাডেমির সামনে একটি অটোরিকশাকে ধাক্কা দিতে যায়। রিকশাটি রাস্তার নিচে নেমে গিয়ে রক্ষা পায়। এরপর গাড়িটি নওদাপাড়া বাজার এলাকায় গিয়ে সাজ্জাদ ট্রেডার্স নামের একটি দোকানের সামনে দাঁড়ানো সাখাওয়াত হোসেন ও ইসমাইল হোসেনকে চাপা দেয়। পরের দোকানের সামনে দাঁড়ানো ছিল আনিকা ও তার সৎবোন মাইমুনা আক্তার। বাসটি আনিকাকে নিয়ে পাশের দোকানটিতে ঢুকে পড়ে।

আনিকা পবা উপজেলার নওহাটা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ছিল। তার বাবার নাম আশরাফুল ইসলাম ওরফে রেন্টু। বাবার বাড়ি নগরের বুলনপুর এলাকায়। বাবার মৃত্যু পরে তার মায়ের বিয়ে হয় নগরের নওদাপাড়া এলাকার রুস্তম আলীর সঙ্গে। মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পর আনিকা পবা উপজেলার নওহাটা মথুরা এলাকায় নানির বাড়িতে থাকত। রুস্তম আলীর প্রথম স্ত্রীর মারা যাওয়ার পর তিনি আনিকার মাকে বিয়ে করেন। আনিকা মাঝেমধ্যে মাকে দেখতে আসত। ঘটনার আগের দিনও সে মায়ের কাছে এসেছিল।

আনিকার সৎবোন মাইমুনা আক্তার জানায়, সে নগরের নওদাপাড়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। আজ তার বিদ্যালয়ে জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় সে আনিকাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। মাইমুনা জানায়, বাড়ি ফেরার সময় আনিকা তার কাছে আইসক্রিম খেতে চেয়েছিল। সে তাকে রাস্তার পাশের একটি দোকানে নিয়ে গিয়ে তার হাতে আইসক্রিম ধরিয়ে দেয়। এরই মধ্যে একটি বাস তাদের চাপা দেয়। সে ধাক্কা খেয়ে পাশের জাহাঙ্গীর ট্রেডার্স নামের একটি ওষুধের দোকানের ভেতরে ঢুকে যায়। আর আনিকা বাসের নিচে চাপা পড়ে। জাহাঙ্গীর ট্রেডার্সে সে সময় বসে ছিলেন জাহাঙ্গীরের বাবা মো. হানিফ (৭২)। তিনি বলেন, বাসটি আকস্মিকভাবে তাঁদের দোকানে ধাক্কা দিয়ে পাশের দোকানে ঢুকে পড়ে। এ সময় দুটি মেয়ে তাঁর দোকানের ভেতরে লাফ দিয়ে ঢোকে আর তাদের সঙ্গের একটি মেয়ে তাঁর চোখের সামনে বাসের নিচে চাপা পড়ে গেল।

ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় ব্যবসায়ী আবদুল ওয়াহিদ বলেন, বেলা প্রায় সাড়ে ১১টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। তার ২০-২৫ মিনিট পর পুলিশ রেকার নিয়ে আসে। রেকার লাগিয়ে গাড়িটি পেছন দিক থেকে টেনে নেওয়া হচ্ছিল আর রাস্তার পাশের মানুষ চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন, যদি মেয়েটাকে জীবিত পাওয়া যায়। তিনি বলেন, গাড়ির নিচ থেকে আনিকাকে যখন বের করা হয়। তখনো মেয়েটা বেঁচে ছিল। হাসপাতালে নেওয়ার জন্য কোনো গাড়ি পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে ফায়ার সার্ভিসের একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

আনিকার খালা অভিযোগ করেন, মেয়েকে গাড়ির নিচ থেকে বের করার আধা ঘণ্টা পরে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, গাড়ির ভয়ে যদি রাস্তাঘাটে বের না হওয়া যায়, তাহলে ছেলেমেয়েদের তাঁরা কীভাবে স্কুলে পাঠাবেন। তিনি এর সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন।

সাখাওয়াতের বাড়ি নগরের শাহমখদুম থানার মোড়ে। আর ইসমাইল হোসেনের বাড়ি একই থানার ম্যাচ ফ্যাক্টরির মোড়ে। তাঁদের পরিচিত এক ব্যক্তি জানান, তাঁরা দুজনেই ডিশ লাইনের ব্যবসা করেন। তাঁরা একই মোটরসাইকেলে চেপে মোহনপুর উপজেলার ত্রিমোহিনী এলাকায় যাচ্ছিলেন।

সাখাওয়াতের দুই মেয়ে। বড়টি প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। দুর্ঘটনায় স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনেই তার স্ত্রী পলি বেগম নির্বাক হয়ে যান। তার বড় মেয়ে সাদিয়া খানম মাকে ডাকছিল। ধাক্কা দিচ্ছিল। কিন্তু মা কোনো কথাই বলতে পারছিলেন না।

নগরের শাহ মাখদুম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিল্লুর রহমান বলেন, দুই মোটরসাইকেলের আরোহী লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়েছে। বাসটি থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে পরে মামলা করা হবে।