বাসযোগ্যতায় উন্নতি হচ্ছে না ঢাকার

বসবাসযোগ্যতার নিরিখে গত সাত বছরে ঢাকা শহরের কোনো উন্নতি হয়নি। ২০১২ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত প্রতিবারই বসবাসের অযোগ্য ১০ শহরের তালিকায় শেষের দিকে ছিল ঢাকা।
‘দ্য ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট’-এর সাত বছরের প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে ১৩৭তম অবস্থানে ছিল ঢাকা, নিচের দিক থেকে এই অবস্থান চতুর্থ। এ বছর সেই অবস্থানটিও হারিয়ে ঢাকা নেমে এসেছে ১৩৯তম স্থানে, নিচের দিক থেকে যা দ্বিতীয়। এর আগে ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্তও এই অবস্থানই ছিল ঢাকা।
প্রতিবারের মতো এবারও পাঁচটি বিভাগে বিশ্বের ১৪০টি শহরে বাসযোগ্যতার তুলনা করেছে দ্য ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট। এগুলো হচ্ছে স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষার সুবিধা এবং অবকাঠামো। প্রতিটি বিভাগেই তিন থেকে নয়টি করে মোট ৩০টি সূচকের ভিত্তিতে শহরের অবস্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। অবস্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রে মোট ১০০ রেটিং পয়েন্ট ধরা হয়েছে। সেখানে এবার ঢাকা পেয়েছে ৩৮ পয়েন্ট, গত বছর ছিল ৩৮ দশমিক ৭। বাসযোগ্য শহরের শীর্ষে থাকা অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার পয়েন্ট ১০০ তে ৯৯ দশমিক ১। আর সবচেয়ে অযোগ্য দামেস্কের পয়েন্ট ৩০ দশমিক ৭।
তবে এই প্রতিবেদনের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সহসভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা। তিনি বলেন, ‘জরিপের এই ফল সম্পর্কে আমি একমত নই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতিসহ অনেক ক্ষেত্রেই ঢাকার অবস্থা লাগোস ও করাচির চেয়ে ভালো।’
এবারের প্রতিবেদনে পাঁচ বিভাগের প্রথমটিতে—স্থিতিশীলতায় ১০০ পয়েন্টের মধ্যে ঢাকা পেয়েছে ৫০। স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও বড় অপরাধ, সন্ত্রাসের হুমকি, সামরিক সংঘাতের ঝুঁকি, নাগরিক অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি—এসব সূচক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, ‘তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আমার দৃষ্টিভঙ্গি মিলবে না। জরিপের ক্ষেত্রে সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় নিতে হবে। উন্নত, স্বল্পোন্নত, অনুন্নত সব দেশ এক ক্যাটাগরিতে বিবেচনা করলে মুশকিল। এতে বিতর্ক থাকে। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের তুলনায় ঢাকায় গুরুতর অপরাধের হার কম।’
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে ১০০ পয়েন্টের মধ্যে ঢাকা পেয়েছে ২৯ দশমিক ২। এই বিভাগে দামেস্কের পয়েন্টও একই। ঢাকার স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আতিকুল হক। তিনি বলেন, কোনো আন্তর্জাতিক জার্নালে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেই সেটি শতভাগ সঠিক, তা নয়। ইকোনমিস্ট জরিপের ক্ষেত্রে প্রাথমিক তথ্য (প্রাইমারি ডেটা) কীভাবে সংগ্রহ করেছে, তা জানতে হবে। এটি জানা গেলে বোঝা যাবে জরিপের তথ্য সঠিক, নাকি বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এই জরিপ করা হয়েছে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে গত ১০ বছরে অনেক উন্নতি হয়েছে। তাঁর মতে, সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত চিকিৎসকদের মান যাচাই করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের দেশেও চিকিৎসকদের সনদ নবায়নের বিষয়টি থাকতে পারে। এতে চিকিৎসা সেবার মান বাড়বে।
সংস্কৃতি ও পরিবেশ—এই বিভাগে শহরের তাপমাত্রা, দুর্নীতি, সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ, খেলাধুলার সুযোগ প্রভৃতি সূচক বিবেচনা করা হয়েছে। এই বিভাগে ঢাকা ১০০ তে পেয়েছে ৪০ দশমিক ৫ পয়েন্ট। এ ক্ষেত্রেও দামেস্ক ও ঢাকার পয়েন্ট সমান।
ঢাকার পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণেই ঢাকার পরিবেশ দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এই অবস্থার উন্নতির জন্য পার্ক, খেলার মাঠ, জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে। ঢাকার আশপাশের ইটভাটাগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, সেগুলোতে উন্নতি প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে বেসরকারি ও সরকারি উভয় ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার সহজলভ্যতা ও মানকে বিবেচনা করা হয়েছে। এই বিভাগে ঢাকা পেয়েছে ৪১ দশমিক ৭ পয়েন্ট। ঢাকায় শিক্ষার মান সম্পর্কে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শিক্ষার মান দিন দিন কমছেই। শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। এটি এখন সহজলভ্য নয়। তিনি বলেন, শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে হলে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ঠিকভাবে পড়াতে হবে, মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। শিক্ষকদের জবাবদিহি থাকতে হবে। তাঁদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ ছাড়া মাতৃভাষায় এক ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে।
অবকাঠামো বিভাগে ঢাকার পয়েন্ট সর্বনিম্ন, ২৬ দশমিক ৮। এটি দামেস্কের চেয়েও কম। এই বিভাগে দামেস্ক পেয়েছে ৩২ দশমিক ১। সাতটি সূচকের ভিত্তিতে অবকাঠামো বিভাগটি নির্ধারিত হয়েছে। যার প্রথমেই রয়েছে সড়ক যোগাযোগ। দুই নম্বরে আছে গণপরিবহন। এই দুই সূচক সম্পর্কে নগর–পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, ঢাকা শহর যেভাবে বেড়েছে সেভাবে রাস্তাঘাট হয়নি। দেড় কোটি মানুষের শহরে এখনো সুশৃঙ্খল গণপরিবহন ব্যবস্থা নেই।
এই বিভাগে অন্য সূচকগুলো হচ্ছে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, আবাসনের সুব্যবস্থা, জ্বালানি, পানি ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা।
অধ্যাপক মাহমুদ বলেন, সামনের বছরগুলোতে অবস্থার উন্নতি করতে হলে শহরকে সচল করতে হবে। জলজট থেকে মুক্তি পেতে হবে। এ ছাড়া শহরের সামাজিক নিরাপত্তা এবং ব্যবহারের উপযোগী গণপরিসর নিশ্চিত করতে হবে।