আরও আন্দোলনকারী গ্রেপ্তার করবে পুলিশ

প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।
>
  • শিক্ষার্থীদের আন্দোলন
  • এক দিনেই তিন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ, অভিযোগ গুজব ছড়ানোর।
  • এখন পর্যন্ত মোট মামলা হয়েছে ৫১ টি, মোট গ্রেপ্তার ৯৭।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘গুজব’ ছড়িয়ে যারা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রাখবে। এর অংশ হিসেবে গতকাল বুধবার কোটা সংস্কার আন্দোলনের একজন যুগ্ম আহ্বায়কসহ তিনজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন আহমাদ হোসাইন (১৯), নাজমুস সাকিব (২৪) এবং ইডেন মহিলা কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী লুৎফুন নাহার ওরফে লুমা। তাঁদের মধ্যে লুৎফুনকে ঢাকা থেকে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের একটি দল ও স্থানীয় থানা-পুলিশ ‘যৌথ অভিযান’ চালিয়ে সিরাজগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করে।

আগের রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের আবাসিক ছাত্রী শেখ তাসনিম আফরোজ ওরফে ইতিকে তুলে আনে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখার পর মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান তিনি। তাঁর বিরুদ্ধেও অভিযোগ কী, সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। পুলিশি নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাসনিম কাউকে কিছু জানাননি বলে প্রথম আলোকে বলেছেন তাঁর বন্ধুবান্ধব। তাঁর পরিবারকেও সতর্ক করা হয়েছে। তাসনিমকে তাঁর বাবা নিজ কর্মস্থলে নিয়ে গেছেন। তিনি কবে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরবেন, সে সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে পারছে না। পুলিম বলছে, শেখ তাসনিম আফরোজের ফেসবুকে তাদের ভাষায় আপত্তিকর পোস্ট ছিল। সেকারণে তাঁকে তুলে আনা হয়েছিল।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অনুসরণ করে গ্রেপ্তার ও অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা আছে। তবে পুলিশ বলছে, তারা গুজব ঠেকাতে বদ্ধপরিকর। পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপরিদর্শক সোহেল রানা বলছিলেন, ‘আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। গুজব ঠেকাতে পুলিশের হাতে যতগুলো মেকানিজম আছে, তার সবটাই আমরা প্রয়োগ করছি। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে যারা গুজব ছড়িয়েছে, তাদের আইনের আওতায় এনে আমরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই।’ প্রথম আলোকে তিনি আরও বলেন, পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সেল বিষয়টি সমন্বয়ের কাজ করছে। ভবিষ্যতেও রাষ্ট্রবিরোধী প্রচার বন্ধে এই সেল কাজ করবে।

গতকালই পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। নিজস্ব ওয়েবপোর্টালে ঢাকা ডিএমপি বলেছে, শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুজন শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে সহিংস ঘটনা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উস্কানির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন থানায় মোট ৫১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত মোট ৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে ২৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৬ জন। সিআইডি ফেসবুক পেজে উসকানিমূলক প্রপাগান্ডা ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে এমন মিথ্যা ও বানোয়াট বক্তব্য, পোস্ট, ফটো বা ভিডিওতে লাইক, শেয়ার ও কমেন্ট না করার অনুরোধ করেছে।

এদিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে গতকাল বলেছে, শান্তিপূর্ণ সমাবেশে সরকারের সহিংস অভিযান নিয়ে যাঁরা সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হয়েছিলেন, তাঁদের গ্রেপ্তারে কর্তৃপক্ষ অভিযান অব্যাহত রেখেছে। এই দফায় মূলত গ্রেপ্তার করা হচ্ছে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্র ও সাংবাদিকদের। এতে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এবং মানুষ কথা বলতে ভয় পাচ্ছে।

অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার লুৎফুনকে
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেত্রী লুৎফুন নাহারের (২২) মুঠোফোন অনুসরণ করা হচ্ছিল অনেক দিন ধরে। বেলকুচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুর রাজ্জাক দাবি করেছেন, লুৎফুন নাহারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হলে তিনি তাঁর দাদার বাড়ি বেলকুচি উপজেলার প্রত্যন্ত চরাঞ্চল বরধুল ইউনিয়নের ক্ষিদ্রচাপরী গ্রামে পালিয়ে যান। ডিএমপির একটি দল তাঁর অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারে ও তাঁকে বুধবার ঘুম থেকে তুলে ধরে আনেন। পুলিশের দাবি, কোটা সংস্কার আন্দলনের নামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য লুৎফুন আগে থেকেই নানা কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকার রমনা থানায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ৫৭ (২) ৬৬ ধারায় মামলা রয়েছে। এর পরপরই লুনাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে লুৎফুনের বোন কেয়া সরকার বলেন, বাবার মৃত্যুর পর থেকেই তাঁরা তিন বোন মায়ের সঙ্গে দাদাবাড়িতে থাকেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত হওয়ায় ছাত্রলীগ তাঁকে নানাভাবে হয়রানি করছিল। হলের আসনও কাটা গেছে। তিনি জুন মাসে সিরাজগঞ্জে মায়ের কাছে চলে আসেন। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা ছিল বলে তাঁরা শোনেননি। সড়ক নিয়ে আন্দোলনের সময় লুৎফুন সিরাজগঞ্জে ছিলেন। তাঁকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
রাত ১০টার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি সূত্র জানায়, গোলাপি রং এর একটি সালওয়ার কামিজ পরে নাক পর্যন্ত ঢেকে একজন নারী আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে শিক্ষার্থী ধর্ষণের গুজব রটিয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছিল লুৎফুনই হচ্ছেন ওই নারী। তবে তাঁরা নিশ্চিত হতে পারছেন না। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রাত পর্যন্ত দায়ের করা হয়নি বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।

এদিকে গতকাল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সংঘবদ্ধ অপরাধ প্রতিরোধ দল আহমাদ হোসাইনকে কামরাঙ্গীরচর ও নাজমুস সাকিবকে পূর্ব রাজাবাজার থেকে গ্রেপ্তার করে। সিআইডি তাঁর ফেসবুক পেজে উল্লেখ করেছে, বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উসকানিমূলক লেখা, পোস্ট, ফটো এবং ভিডিওর মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির চেষ্টা করায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আদালত তাঁদের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।

পাঁচ মামলায় ১২ গ্রেপ্তার
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের সাইবার অপরাধ বিভাগ এখন পর্যন্ত নয়জনকে গ্রেপ্তারের তথ্য দিয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন চাকরিজীবী মো. ওয়ালীউল্লাহ, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা তৌহিদ তুষার, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র দাইয়ান নাফিস প্রধান, ছাত্র ইহসান উদ্দিন ইফাজ, গ্রাফিক ডিজাইনার মাহবুবুর রহমান, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আলমগীর হোসেন, সাইদুল ইসলাম অহিদ, জুম বাংলার কর্ণধার ইউসুফ চৌধুরী, অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রহমান সামগ্রিক বিষয় নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, গুজব দুভাবে ছড়ায়। কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গুজব ছড়াতে পারে। আবার যদি তথ্যপ্রবাহ অবাধ না হয়, তথ্যের অভাব দেখা দেয়, তাহলেও গুজব ছড়াতে পারে। সাম্প্রতিক ছাত্র বিক্ষোভের সময় মূলধারার পত্রপত্রিকাগুলো মোটামুটি খবর ছেপেছে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনায় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এর আগে যেমন সরাসরি সম্প্রচার করেছে, অনেক দর্শকেরই অভিযোগ সেটা নিরবচ্ছিন্নভাবে হয়নি। তাই তাঁরা ফেসবুকের ওপর নির্ভর করেছেন। অনেকেই ভেবেছেন অনেক কিছু ঘটে যাচ্ছে, তাঁরা টেলিভিশনে সেটা দেখতে পাচ্ছেন না। অনেকে না বুঝেও ফেসবুকে পাওয়া বিভিন্ন খবর শেয়ার করেছেন।