শিশুটির অন্য রকম কষ্ট

প্রাণ বাঁচাতে প্রায় এক বছর আগে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসে রোহিঙ্গা পরিবারটি। আশ্রয় মেলে কক্সবাজারের কুতুপালং ও বালুখালীর ঠ্যাংখালী ক্যাম্পে। পরিবারের আট সন্তানের মধ্যে সপ্তম নূরুল জোহার। বয়স মোটে পাঁচ বছর। সাত মাস আগে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ধাক্কায় গুরুতর আহত হয় শিশুটি। তারপর থেকেই সন্তানকে বাঁচাতে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরছে পরিবারটি। শুরু হয়েছে অন্য রকম কষ্ট।

আহত হওয়ার পর ফুটফুটে নূরুল জোহারকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় কক্সবাজারে মেমোরিয়াল ক্রিশ্চিয়ান হাসপাতালে। উন্নত চিকিৎসার জন্য এরপর নেওয়া হয় অন্য হাসপাতালে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন জায়গায় তার চিকিৎসা চলছে। সড়ক দুর্ঘটনায় শিশুটির যকৃৎ থেকে পিত্তনালি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

দুর্ঘটনার পর জোহারের দায়িত্ব নেয় ক্যাম্পে কর্মরত শমরীতান পার্স নামের একটি বিদেশি এনজিও। এ এনজিওর মাধ্যমে তাকে কক্সবাজারের মেমোরিয়াল ক্রিশ্চিয়ান হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরই মধ্যে শিশুটির ছোট্ট শরীরে করতে হয়েছে তিনটি জটিল অস্ত্রোপচার।

উন্নত চিকিৎসার জন্য ৮ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক আবদুল হানিফের অধীনে জোহারকে ভর্তি করা হয়। চলে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। শনিবার জোহার আবার ফিরে গেছে কক্সবাজারে। ক্যাম্পে পরিবারের সঙ্গে ঈদ করে আবার ঢাকায় ফিরবে সে। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জোহারের আবার অস্ত্রোপচার হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান আশরাফ উল হক প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা শিশুটির জন্য মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। শিশুটির অবস্থা বেশ জটিল। বলা যায়, ওকে কোনোক্রমে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। ওর শরীর থেকে পিত্ত বাইরে বের হয়ে যাচ্ছে। পিত্ত বের হয়ে গেলে মানুষকে বাঁচানো যায় না। তাই পাকস্থলীতে ছিদ্র করে একটি নল দিয়ে পিত্তকে আবার শিশুটির শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে তিনটি নল নিয়ে শিশুটি বেঁচে আছে। এবার অস্ত্রোপচার করে ক্ষতিগ্রস্ত পিত্তনালিকে সম্ভব হলে পুনর্গঠন বা প্রতিস্থাপন করতে হবে। অস্ত্রোপচারটি জটিল। একটু এদিক-সেদিক হলেই লিভারসহ শিশুটির শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে।

সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ বছরের নূরুল জোহারের যকৃৎ থেকে পিত্তনালি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ছবি: মানসুরা হোসাইন
সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ বছরের নূরুল জোহারের যকৃৎ থেকে পিত্তনালি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ছবি: মানসুরা হোসাইন

গত বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেবিনে গিয়ে দেখা গেল নূরুল জোহারকে। তার শার্টের নিচ দিয়ে একটি নল বাইরের দিকে বের করে তা গলায় পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে। এ অবস্থাতেই চিকিৎসক ও অন্যদের সঙ্গে বল খেলছিল জোহার। খানিকটা বাংলা ও মিয়ানমারের ভাষায় অনবরত কথা বলে সবাইকে বেশ মাতিয়ে রেখেছে শিশুটি। কবিতা বলছে, গান গাইছে।

এনজিও শমরীতান পার্সে নার্স হিসেবে কর্মরত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক জেসিকা লুইস এবং এনজিও থেকে নিয়োগ পাওয়া দোভাষী সুকর্ণ ঘোষ সারাক্ষণ জোহারের সঙ্গেই থাকছেন।

জোহারের বাবা মো. কুতুব বাংলা বুঝতে এবং বলতে পারেন না। ক্যাম্পে কোনো কাজ করতেন না তিনি। এখন জোহারের সঙ্গেই থাকতে হচ্ছে সার্বক্ষণিক। ছেলের শরীরে বড় অস্ত্রোপচারটি সফল হওয়ার আশায় আছেন মো. কুতুব। তাঁর কথায়, এতে ছোট্ট জোহারের কষ্টের মাত্রাটাও কমবে।