নারীর দুর্ভোগ পথে পথে

দীর্ঘ অপেক্ষার পরও অনেক সময় বাসে উঠতে পারেন না নারীরা। ছবি: সুমন ইউসুফ
দীর্ঘ অপেক্ষার পরও অনেক সময় বাসে উঠতে পারেন না নারীরা। ছবি: সুমন ইউসুফ

লালমাটিয়ার আফরোজা শারমীন গুলশানের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। গণপরিবহনেই তিনি অফিসে যাতায়াত করতে চান। কিন্তু প্রায় প্রতিদিন সকালে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে অনেকক্ষণ চেষ্টার পরেও বাসে উঠতে ব্যর্থ হন। বাধ্য হয়ে তাঁকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চলাচল করতে হয়। ফেরার সময়ও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।

আফরোজা শারমীন বলেন, ‘সকালে ও বিকেলে বাসে প্রচণ্ড ভিড় থাকে। ফলে বেশির ভাগ সময়ই উঠতে পারি না। অটোরিকশায় যাতায়াতে এক দিনে কমপক্ষে ৫০০ টাকা খরচ হয়। এতে বেতনের একটি বড় অংশ রাস্তাতেই চলে যায়। কর্মজীবী নারীদের পরিবহনের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত সরকারের।’

এই অভিজ্ঞতা কেবল রাজধানীর আফরোজা শারমীনের নয়। নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাইকেই যাতায়াতে তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তবে কর্মজীবী নারীদের ভোগান্তি আর হয়রানি অন্যদের তুলনায় বেশি। চালকের লাইসেন্স না থাকা, গাড়ির ফিটনেস না থাকাসহ নানা কারণে সাম্প্রতিক সময়ে গণপরিবহনের সংখ্যা সড়কে অনেক কমে গিয়েছিল। ফলে চলাচলে নারীদের দুর্ভোগের মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। বাধ্য হয়ে কর্মজীবী নারীদের অটোরিকশায় চলতে গিয়ে গুনতে হয়েছে বাড়তি টাকা। অথবা অনেক সময় দাঁড়িয়ে ঠেলাঠেলি করে কোনোমতে গণপরিবহনে ঠাঁই নিতে হয়েছে।

একটি ফ্যাশন হাউসে চাকরি করেন দিলশাদ হোসেন। বেতনের অঙ্ক খুব একটা বড় নয়। অটোরিকশার খরচ বহন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘একের পর এক বাস চলে যায়। যাত্রী ভরা থাকায় উঠতে পারি না। কোনো হেলপারের মায়া হলে ওঠার সুযোগ দেন। কোনোমতে দাঁড়িয়ে কর্মস্থলে পৌঁছাই। এর মধ্যেই আবার কিছু সুযোগসন্ধানী পুরুষ নিপীড়নের চেষ্টা করেন।’

নারীদের অভিযোগ, রাজধানীতে দিন দিন বাড়ছে কর্মজীবী নারীদের সংখ্যা। সে তুলনায় তাঁদের জন্য গণপরিবহনের বরাদ্দ খুব কম। বাসে অফিসে যাওয়া-আসার সময় যাত্রীর চাপ বেশি থাকে। চালকের সহকারীরা সে সময় নারীদের বাসে উঠতে দিতে চান না। ওঠানামা করার সময় গায়ে হাত দেন। খারাপ ব্যবহার করেন। তারপরেও ধাক্কাধাক্কি করে ওঠার পরে পুরুষ সহযাত্রীরাও নানা রকম হয়রানি করে থাকেন। কেবল যাতায়াতে ভোগান্তির কারণে অনেক কর্মজীবী নারী চাকরি ছেড়ে দেন বলে জানান তাঁরা।

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, গণ পরিবহনের অব্যবস্থাপনা চরম আকার ধারণ করেছে। এর মধ্যে নারীদের দুর্ভোগ বেশি পোহাতে হচ্ছে। সরকারের উচিত এই ভোগান্তি সহনীয় করার বিষয়টি খেয়াল করা।

নারীদের জন্য পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা এসব ভোগান্তি-হয়রানি কমাতে পারে বলে মনে করেন কর্মজীবী অনেক নারী। পাশাপাশি এতে নারীরা চাকরি করতে আরও উৎসাহিত হবেন। একই বাসে নারীদের জন্য পৃথক বসার দাবিও জানান তাঁরা।

সরকারি ব্যবস্থাপনায় নারীদের জন্য ঢাকা এবং চট্টগ্রাম শহরে বর্তমানে ১৯টি বাস চলছে। এর মধ্যে রাজধানীতে চলে ১৭টি বাস। নারীদের বাসগুলো রবি থেকে বৃহস্পতি-সপ্তাহের পাঁচ দিন চলে। এসব বাসের চালক পুরুষ হলেও কন্ডাক্টর নারী। পাশাপাশি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় মিরপুর ১২ নম্বর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দোলনচাঁপা নামে একটি বাস চলছে।

তবে বাসগুলোর সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট নন নারী যাত্রীরা। তাঁদের অভিযোগ, নারীদের জন্য বরাদ্দ করা বাসগুলো তুলনামূলক পুরোনো। ভাঙাচোরা বাসগুলো জোড়াতালি দিয়ে কোনোভাবে চালানো হয়। ফলে প্রায়ই মাঝপথে মধ্যে নষ্ট হয়। তখন বাসগুলো সারাইয়ের জন্য দীর্ঘক্ষণ যাত্রীদের অপেক্ষা করতে হয়। কিংবা নেমে অন্য পরিবহনে উঠতে হয়, সেটা বেশ ঝক্কির।

শহরের নারীদের তুলনায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় বাসের সংখ্যা অপর্যাপ্ত মনে করেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের চেয়ারম্যান ফরিদ আহমদ ভূঁইয়া। তিনি বলেন, যাতায়াতে নারীদের দুর্ভোগ কমাতে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ বছরের শেষ নাগাদ নতুন ৬০০ বাস নামার কথা। রুটের চাহিদা হিসেবে নারীদের জন্য বেশকিছু বাস বরাদ্দ দেওয়া হবে। এর পাশাপাশি বর্তমান বাসগুলোতে নারী-পুরুষের পৃথক বসার ব্যবস্থা চালুর জন্য একটি পাইলট প্রজেক্ট চলছে। প্রজেক্টে ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া গেলে নারীদের হয়রানি বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ হবে। এর পাশাপাশি নারীদের জন্য বরাদ্দ করা বাসে নারীচালক নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।