নেপথ্যে আধিপত্য ও চাঁদাবাজি

বাড়ির আঙিনায় চলছে শেষকৃত্যের আয়োজন। কাঁদছেন জিতায়ন চাকমা ও রূপম চাকমার আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা। গতকাল দুপুরে খাগড়াছড়ি শহরের উত্তর খবংপুড়িয়া এলাকায়।  ছবি: নীরব চৌধুরী
বাড়ির আঙিনায় চলছে শেষকৃত্যের আয়োজন। কাঁদছেন জিতায়ন চাকমা ও রূপম চাকমার আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা। গতকাল দুপুরে খাগড়াছড়ি শহরের উত্তর খবংপুড়িয়া এলাকায়। ছবি: নীরব চৌধুরী
  • ৯ মাস ধরে সংঘাত-হানাহানি চলছে পাহাড়ে
  • সর্বশেষ শনিবার গুলিতে ছয়জন নিহত হন
  • নতুন করে হামলার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষ

খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর বাজারের দক্ষিণে কয়েক মিনিটের হাঁটাপথ। এলাকার নাম উত্তর খবংপুড়িয়া। এইচএসসি পরীক্ষার্থী রূপম চাকমার বাড়ি। গত শনিবার সকালে অতর্কিত হামলায় নিহত ব্যক্তিদের একজন রূপম। বাড়ির আঙিনায় চলছে শেষকৃত্যের কাজ। বাবা সুগত চাকমা আর্তনাদ করে বলছেন, ‘আমার ছেলে মারা গেছে। আমি জানি, কী গেছে। চলে যান আপনারা।’

অজানা এক চাপ, আতঙ্ক ভর করছে সুগত চাকমা ও আশপাশের মানুষের মধ্যে। নতুন করে রক্তপাতের আশঙ্কা এখন এখানকার মানুষের মুখে মুখে।

নয় মাস ধরে এমন চলছে পাহাড়ে। এর পেছনে রয়েছে স্থানীয় দলগুলোর চাঁদাবাজি, দলীয় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা ও পাহাড়ি দলগুলোর বিভক্তি।

খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, আঞ্চলিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এসব ঘটছে। বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের মধ্যে কাজ করছে।

পেছনের কারণ
গতকাল সকালে স্বনির্ভর বাজারে কথা হয় সহকারী পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আফতাব উদ্দিনের সঙ্গে। তাঁর ভাষ্য, মূলত চাঁদাবাজির কারণে পাহাড়ে সংঘাত হচ্ছে। কেউ ২০ টাকা, কেউ ১০ টাকার জন্য পরস্পরের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত।

পুলিশ জানায়, চাঁদাবাজি ও আধিপত্যের কারণে গত ২০ মে থেকে বন্ধ রয়েছে পানছড়ি বাজার। অভিযোগ রয়েছে, জেএসএসের (এম এন লারমা) কয়েকজন নেতা তখন ওই বাজারের একটি হোটেলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। জানতে পেরে ইউপিডিএফ বাজারটি বন্ধ করে দেয় বলে অভিযোগ।

এরপর ১৩ আগস্ট পানছড়ি সড়কের পাশের ১০টি ছোট ছোট বাজার জেএসএস (এম এন লারমা) বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

নতুন দল গড়ার পর সহিংসতা
১৯৭২ সালে পাহাড়ের মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য জেএসএস গঠিত হয়। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি হওয়ার পর জেএসএসের বাইরে ইউপিডিএফ নামে নতুন দল গঠিত হয়। পরে ২০১০ সালে মূল জেএসএস ভেঙে গঠিত হয় জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা)। ২০১৫ সালে আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে খুনোখুনি প্রায় বন্ধ ছিল। সর্বশেষ গত বছরের ১৫ নভেম্বর ইউপিডিএফ ভেঙে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে নতুন ধারার সৃষ্টি হয়। নতুন দল গঠনের পর ৫ ডিসেম্বর থেকে মূলত পাহাড় অশান্ত হয়ে ওঠে। দল গঠনের সাত মাসের মাথায় গত ৪ মে খুন হন দলীয় প্রধান তপনজ্যোতি চাকমা।

সর্বশেষ শনিবার স্বনির্ভর বাজারে গুলিতে ছয়জন নিহত হন। এর কিছু দূরে প্যারাছড়ায় পালাতে গিয়ে আছাড় খেয়ে অপর একজনের মৃত্যু হয়। ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলটি এম এন লারমা দলের সমর্থনে এসব হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ইউপিডিএফের মুখপাত্র মাইকেল চাকমা।

তিনি মুঠোফোনে বলেন, একটি গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে ভুঁইফোড় কিছু দল গঠন করে পাহাড়ের জনগণের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। চাঁদাবাজির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জনগণের চাঁদায় সব দল চলে। কিন্তু ইউপিডিএফ জনগণের কল্যাণে চাঁদা ব্যবহার করে, ব্যক্তিস্বার্থে নয়।

২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত ইউপিডিএফের ১৬ নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। অপহৃত হয়েছেন ইউপিডিএফের দুই নেত্রী। অপর দিকে পাল্টা হামলায় জেএসএস (এম এন লারমা) ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের ১৩ নেতা-কর্মী নিহত হন। এর বাইরে পাঁচ নিরীহ মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

পাল্টাপাল্টি হামলা প্রসঙ্গে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের সভাপতি শ্যামল চাকমা বলেন, নদীর কূল যখন একবার ভাঙা শুরু হয়, তখন শক্ত মাটি না পাওয়া পর্যন্ত ভাঙন চলতে থাকে। সর্বশেষ ঘটনা ইউপিডিএফের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘চাঁদাবাজির টাকা দিয়ে অন্য দলের নেতারা বাড়ি-গাড়ি করেছেন। আমরা নিজেদের দল ও পাহাড়ের জনগোষ্ঠীর কাজে চাঁদা ব্যবহার করেছি।’

উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষ
পাহাড়ের চলমান সংঘাত নিয়ে উদ্বিগ্ন সাধারণ নাগরিকেরা। গতকাল খাগড়াছড়িতে কয়েকজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা হয়। কেউই নাম বলতে চাইলেন না। তাঁদের মধ্যে কেবল আতঙ্ক। খাগড়াছড়ির সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক সুধীন কুমার চাকমাও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এমনকি সহিংসতায় স্বজন হারানো পরিবারগুলোও বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছে। শনিবার নিহত জিতায়ন চাকমার মেয়ে পলি চাকমা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘কে বিচার করবে? কার কাছে বিচার চাইব? কিসের বিচার? তারা আমাদের এভাবেই মেরে ফেলবে।’