প্রিয় মুখগুলোর জন্য এত কষ্ট!

শিমুলিয়া ঘাটে ফেরিতে উঠতে দাঁড়িয়ে শত শত যানবাহন। ছবি: আলিম উজ-জামান
শিমুলিয়া ঘাটে ফেরিতে উঠতে দাঁড়িয়ে শত শত যানবাহন। ছবি: আলিম উজ-জামান

‘মাইয়া, মাইয়ারে তুই অপরাধী, অপরাধী রে,...মাইয়া তুই বড় অপরাধী, তোর ক্ষমা নাই রে’—বাসের মধ্যে পাশের সহযাত্রীর কণ্ঠে এই গান বেশ ভালোই লাগছিল। সকাল থেকে ভোগান্তি পোহাচ্ছি, তবে কেন জানি খারাপ লাগছে না। ফেরির জন্য বসে আছি মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে। চারপাশের উৎসবমুখর একটি পরিবেশ বিরক্তিভাবটা কাটিয়ে দিচ্ছে।

আজ ও কাল—দুই রাত পোহালেই ঈদ। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করতে আমিও একজন বাড়িগামী যোদ্ধা। সকাল নয়টার দিকে দক্ষিণবঙ্গে যাওয়ার উদ্দেশে সায়েদাবাদ থেকে বাসে উঠেছি। বাস অবশ্য ছাড়ার কথা ছিল সাড়ে আটটায়। মালিবাগ থেকে বাসগুলো রওনা দিয়ে টিটিপাড়াতে গরুর হাটে জ্যামে পড়ে, তাই সায়েদাবাদে সময়মতো আসতে পারেনি। গরমে ছোট বাচ্চাদের নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে পড়েন যাত্রীরা। অনেকে বলছিলেন, ‘বাস আসতে যেহেতু দেরি করছে, ঘাটে ফেরি ছাড়তেও দেরি করবে।’

শুরুতেই আধা ঘণ্টা দিয়ে বিড়ম্বনার শুরু। এরপর ঢাকা ছাড়তে বিভিন্ন পয়েন্টে থমকে থমকে থেমেছে বাস। সুযোগ বুঝে উঠে পড়ছে ফেরিওয়ালারা। অবিরত কণ্ঠে তাঁদের পণ্য কেনার অনুরোধ। জ্যামে আটকে গাড়ি, গরমে অতিষ্ঠ বাচ্চারা। ঢাকা ছাড়তেই লাগল দুই ঘণ্টা।

ফেরিঘাটে নেমে দেখা যায় উত্তাল পদ্মা। ছবি: আলিম উজ-জামান
ফেরিঘাটে নেমে দেখা যায় উত্তাল পদ্মা। ছবি: আলিম উজ-জামান

শিমুলিয়া ঘাট দিয়ে দক্ষিণ বঙ্গের পরিবহনগুলো পদ্মা পার হয়ে মাদারীপুর, শরীয়তপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় যায়। ঘাটের আগে আগে রাস্তায় থমকে দাঁড়াল আমাদের বাস। শত শত বাস, প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে আছে। নড়ছে না কেউ এতটুকু। বেলা ১১টা থেকে দুপুর সোয়া ১২টা পর্যন্ত আমাদের বাস এগিয়েছে মাত্র ১৫ ফুট। বেশ গরম। ফেরিতে উঠতে আরও দুই তিন ঘণ্টা যে লেগে যাবে, তা বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে।

রাজ্যের বিরক্তি এসে জড়ো হচ্ছে। হঠাৎই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চোখ পড়ল উত্তাল পদ্মার দিকে। এক পশলা ঠান্ডা বাতাস যেন ছুঁয়ে দিল মনকে। বাড়ি পৌঁছালেই দেখা হবে প্রিয়জনের সঙ্গে। এই অপেক্ষা এত মধুর, যে বিড়ম্বনা হেরে যায়। নদীর প্রচণ্ড ঢেউ, এর মধ্যেই ট্রলার, লঞ্চ, স্পিডবোটগুলো ছুটে যাচ্ছে। সবাই যেন আমার মতোই একজন। ব্যস্ত জীবনে বছরে খুব কমই গ্রামের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ হয় নগরবাসীর। আর আমার মতো অনেকে আছেন, যাঁদের এক ঈদে ছুটি মেলে তো আরেক ঈদে মেলে না। তাই বাড়ি যাওয়াটা যেন সব সমই আনন্দের।

যাত্রী নিয়ে লঞ্চগুলো ছুটে চলছে। ছবি: আলিম উজ-জামান
যাত্রী নিয়ে লঞ্চগুলো ছুটে চলছে। ছবি: আলিম উজ-জামান

ঈদযাত্রায় আজ সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ ঢাকা ছাড়ছে। শিমুলিয়া ঘাট থেকে দক্ষিণবঙ্গের গাড়িগুলো যাবে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ঘাটে। বাস থেকে নেমে চারদিকে দেখছিলাম। ঘাটে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছেন লঞ্চ ধরার উদ্দেশে। আকাশে মেঘ। যেকোনো সময় শুরু হবে বৃষ্টি। প্রতিবছরই ঈদে বাড়ি যাওয়া নিয়ে কত কষ্ট পোহাতে হয় এই রাজধানীবাসীর। শুরুতে টিকিট নিয়ে ভোগান্তি। এরপর যানজটে ৫-৬ ঘণ্টার পথ ১০-১২ ঘণ্টায় যাওয়া। কারও কারও তো শুনি এক দিনও লেগে যায় যেতে। এরপরও নগর জীবনে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষগুলো একটু স্বস্তির আশায় ছুটে যায় সবুজের ঘ্রাণ নিতে। আপন ঠিকানায় পা দিয়ে প্রিয় মুখগুলোর সান্নিধ্যে প্রাণ জুড়াবে সবার।