'গ্রেনেডটি ট্রাকে পড়লে আপাকে বাঁচানো যেত না'

গ্রেনেড হামলা চলাকালে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। ছবি: জিয়া ইসলাম
গ্রেনেড হামলা চলাকালে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। ছবি: জিয়া ইসলাম


(২১ আগস্ট, ২০০৮ সালে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন। বানানরীতি ও অন্যান্য বিষয় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।)

“আপা বক্তৃতা শেষ করার ঠিক আগ মুহূর্তে তাঁর পেছন দিকে গা ঘেঁষে অবস্থান নিই। জয়বাংলা বলে উনি বক্তৃতা শেষ করতেই একটা বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শুনে তাত্ক্ষণিক তাঁকে বসানোর চেষ্টা করি। কিন্তু তিনি বসতে চাচ্ছিলেন না। বরং ‘কী হলো, কোথায় আওয়াজ’-এ রকম কিছু একটা বলে তিনি আশপাশ দেখার চেষ্টা করলেন। তবে পরক্ষণেই তাঁর কাঁধে ধরে অনেকটা জোর করেই ট্রাকের পাটাতনের ওপর বক্তৃতা মঞ্চ হিসেবে রাখা টেবিলটিকে আড়ে রেখে তাঁকে বসিয়ে দিই। প্রথম পর্যায়ে আমি ও মোহাম্মদ হানিফ এবং পরে আরও কয়েকজন নেতা আপাকে ঘিরে রাখি। ”
কথাগুলো বললেন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সময় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার (ফিজিক্যাল প্রটেকশন) দায়িত্বে থাকা অবসরপ্রাপ্ত স্কোয়াড্রন লিডার আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি ট্রাকে ওঠার জন্য ব্যবহূত সিঁড়িতে পা রেখে পাটাতনের ওপর রাখা টেবিলের কোনায় বসেছিলেন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়েই শেখ হাসিনা বক্তৃতা দেন। ওই দিন শেখ হাসিনার নিরাপত্তার প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে তিনি সবকিছু প্রত্যক্ষ করেছেন খুব কাছ থেকে। গ্রেনেড হামলায় তিনি নিজেও আহত হন। তাঁর শরীরে এখনো রয়ে গেছে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার।
গত সোমবার প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতায় স্কোয়াড্রন লিডার (অব.) মামুন সেদিনের রোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দেন। শেখ হাসিনা কীভাবে প্রাণে রক্ষা পেলেন, তার বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি।

জনাব মামুন ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৯৭ সালের ১০ জুন পর্যন্ত (মাঝে এক বছর বাদে) বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী-এসএসএফের সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ, রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৯৮ সালের ১০ জুন স্কোয়াড্রন লিডার হিসেবে বিমানবাহিনী থেকে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর নেন। ২০০১ সালের ১৫ অক্টোবর শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন তিনি। এখনো সেই দায়িত্ব পালন করছেন।
স্কোয়াড্রন লিডার মামুন বলেন, ‘ট্রাকের ওপর আপাকে আমাদের শরীর দিয়ে ঘিরে রাখা অবস্থায় আরও চার-পাঁচটি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ শুনি। অবস্থার ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে ওনাকে হামাগুড়ি দিয়ে নামানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সিঁড়ির কাছে যেতেই একটি গ্রেনেড ট্রাকের ডালায় পড়ে তা গড়িয়ে নিচে বিস্ফোরিত হয়। ট্রাকের নিচে বিস্ফোরিত গ্রেনেডের আঘাতে তেলের ট্যাংক ফেটে যাওয়ায় আগুন লাগতে পারে আশঙ্কা করে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়ানো আমার সহকর্মী অপর নিরাপত্তা কর্মকর্তা মেজর (অব.) শোয়েব আপাকে দ্রুত নামানোর জন্য বলেন। তখন দ্বিতীয় চেষ্টায় তাঁকে নিরাপদে গাড়িতে ওঠাতে সমর্থ হই।’

শেখ হাসিনার নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, “আপাকে যখন ট্রাক থেকে নামাই, তখন ওনার পায়ে স্যান্ডেল ও চোখে চশমা ছিল না। নামানোর সময় আহত কর্মীদের আর্তনাদ আর কাতরানো দেখে তিনি আমাকে বলেন, ‘কোথায় নিচ্ছ আমাকে? এদের কী হবে?’ একরকম জোর করেই ওনাকে গাড়িতে ওঠাই। গাড়ির সামনের আসনে আপা, পেছনের আসনে মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক (শেখ হাসিনার প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা), আমি, মেজর শোয়েব, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও নজিব। দ্রুততার সঙ্গে আমরা স্থান ত্যাগ করি। তখনো গ্রেনেড ও গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। গ্রেনেডের আঘাতে চাকা পাংচার হলেও গাড়িটি মার্সিডিজ বেঞ্জ হওয়ায় প্রায় ৮০ মাইল বেগে ভাসানী স্টেডিয়াম, জিপিও, জিরো পয়েন্ট, সচিবালয়, দোয়েল চত্বর, শহীদ মিনার, পলাশী, ইডেন কলেজ, নীলক্ষেত মোড়, বিডিআর তিন নম্বর গেট ও জিগাতলা হয়ে সুধা সদনে পৌঁছাই। ” তিনি বলেন, ‘গাড়িটি জিরো পয়েন্টে আসার পরই আপার শারীরিক কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না খোঁজ নিই। ওনার শাড়িতে রক্তের দাগ দেখে কোনো আঘাত লেগেছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো সমস্যা নেই। তখন আপাও আমাদের কিছু হয়েছে কি না জানতে চান। অবশ্য সুধা সদনে আসার পর রক্তাক্ত শরীরে স্প্লিন্টারের আঘাত টের পাই। তার আগে কিছুই বুঝতে পারিনি।’

জনাব মামুন বলেন, ‘যে গ্রেনেডটি ট্রাকের ডালায় পড়ে গড়িয়ে নিচে পড়েছিল, সেটি পাটাতনে পড়লে আপাসহ আমরা সবাই মারা যেতাম। মানববর্ম রচনা করে আমরা যাঁরা শরীর দিয়ে ওনাকে ঘিরে রেখেছিলাম, তাতেও তিনি রক্ষা পেতেন না। একমাত্র আল্লাহই তাঁকে বাঁচিয়েছেন।’
ওই দিন সরকারি নিরাপত্তারক্ষীদের দায়িত্ব পালন সম্পর্কে স্কোয়াড্রন লিডার মামুন বলেন, ‘আমরা যখন সুধা সদন থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে যাই, তখন আপার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দায়িত্বে দুটি গাড়িতে ১৬ জন পোশাকধারী পুলিশ এবং অপর একটি গাড়িতে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) আটজন গানম্যান ছিলেন। কিন্তু প্রথম গ্রেনেড বিস্ফোরণের পরপরই তাঁরা সবাই প্রাণ বাঁচাতে এদিক-ওদিক চলে যান। পুলিশের গাড়ির কোনো চালকও ছিল না। আমরা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী ছাড়া একা ফিরি। ড্রাইভার না থাকায় আপার একজন ব্যক্তিগত কর্মচারী এসবির গাড়িটি চালিয়ে নিয়ে আসেন।’