প্রত্যক্ষদর্শী এক সাংবাদিকের চোখে

আইভি রহমানকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা।  ছবি: জিয়া ইসলাম
আইভি রহমানকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা। ছবি: জিয়া ইসলাম


(২১ আগস্ট, ২০০৬ সালে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন। বানানরীতি ও অন্যান্য বিষয় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। লেখক প্রথম আলোর তৎকালীন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ছিলেন।)


এখনো চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই, রাজপথ ভেসে যাচ্ছে তাজা রক্তে। এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে নারী-পুরুষের ছিন্নভিন্ন দেহ। কেউ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, কেউবা নিথর, নিস্তব্ধ।

দেখতে দেখতে দুই বছর হয়ে গেল। এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার সেই ভয়াল বিভীষিকাময় দৃশ্য। প্রায়ই স্বপ্নে দুঃস্বপ্নের মতো হানা দেয় শত শত মানুষের আর্তচিত্কার। রক্তের স্রোত আর মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের শেষ গোঙানি কানে ভেসে আসে। বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, ছেঁড়া স্যান্ডেল, পড়ে থাকা রক্তাক্ত ব্যানার ছাপিয়ে এখনো শুনতে পাই ছিন্নভিন্ন দেহ নিয়েও বেঁচে থাকার জন্য মানুষের কী আকুতি! 

২১ আগস্ট ২০০৪। শনিবার। দিনের অ্যাসাইনমেন্ট বিকেলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউর সামনে আওয়ামী লীগের ডাকা সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ। সিলেটে বোমা হামলার প্রতিবাদে ডাকা এ সমাবেশে বক্তব্য রাখবেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। পল্টনে সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলাসহ কয়েক বছরের ঘটনার পর থেকে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ মানেই অজানা আশঙ্কা-‘কী জানি কী হয়’।
মনে পড়ে, সেদিন জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের কাছে পায়ে হেঁটে পৌঁছাতে আমাকে বিশাল জনস্রোত পার হতে হয়েছিল। মঞ্চ হিসেবে ব্যবহারের জন্য রাখা ছিল একটি ট্রাক। একের পর এক মিছিল আসছে। রাস্তায় দাঁড়িয়েও সমাবেশের বক্তৃতা টোকাটুকি আর সম্ভব হচ্ছিল না।
সেদিন খুব গরম পড়েছিল। কিছুক্ষণ মঞ্চের কাছে দাঁড়িয়ে কোনো সাংবাদিককে না দেখে একটু ছায়ায় যাওয়ার চেষ্টা করি। এ সময় রমনা ভবনের নিচের ফুটপাতে অন্য এক সাংবাদিককে দেখে ভিড় ঠেলে তার কাছে যাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে আরও কিছু সাংবাদিক জড়ো হন।
মঞ্চ হিসেবে ব্যবহূত ট্রাকটি আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও বাটার দোকানের দুই দরজার সামনে রাখা। আমরা রমনা ভবনের সিঁড়িতে দাঁড়ালাম। একসময় বক্তৃতা শুরু হয়। আমরা সেসব টুকতে থাকি। পাঁচটার দিকে মঞ্চে ওঠেন শেখ হাসিনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি বক্তৃতা শুরু করেন। আমরা মঞ্চ থেকে ১০-১৫ গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছি। মানুষের কোলাহলের কারণে বক্তৃতা ঠিক কানে আসছিল না। শেখ হাসিনার বক্তৃতার একেবারে শেষ পর্যায়ে আমি রমনা ভবনের পেট্রলপাম্পের গলিমুখে চলে যাই। কয়েক বছরের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থেকে জানতাম, শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে। তাই একটি জুতসই ইন্ট্রো (সংবাদ সূচনা) করার আশায় অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে মঞ্চের কাছাকাছি চলে যাই। কী ইন্ট্রো করব, ভাবছিলাম। কারণ যেকোনো মুহূর্তে তিনি ‘জয় বাংলা’ বলে বক্তৃতার ইতি টানবেন। তখনো কি জানতাম, কী ভয়াবহ এক ইন্ট্রো অপেক্ষা করছে আমার জন্য!
শেখ হাসিনা যথারীতি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে ২০-২২ মিনিটের বক্তৃতা শেষ করলেন। হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে শেখ হাসিনা মঞ্চ থেকে নামার মুহূর্তেই প্রচণ্ড একটি শব্দ হলো। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, এর কয়েক গজের মধ্যে ট্রাকের আশপাশে শব্দটি হয়েছে বলে মনে হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংঠনগুলোর সংঘর্ষের সুবাদে গুলি ও বোমার আওয়াজ শুনে মোটামুটি অভ্যস্ত ছিলাম। সাংবাদিকতা করতে এসে পুলিশের কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেটের শব্দের সঙ্গেও পরিচিত হয়েছি। কিন্তু একটু আগে যে শব্দটি শুনলাম, এমন কোনো শব্দ আগে শুনেছি বলে মনে হলো না।
এর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একই দিক থেকে পরপর আরও দুটি শব্দ শুনলাম। আমি আগের অবস্থানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। কী করব, বুঝে উঠতে পারছি না। জীবনে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি আগে হইনি কখনো। রমনা ভবনের ফুটপাত আর পেট্রলপাম্পের গলিমুখের সংযোগস্থল দাঁড়িয়ে থাকায় ভিড় কিছুটা কম মনে হচ্ছিল। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় শব্দের পরও একই স্থানে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মুহূর্তের মধ্যেই ছুটে আসা মানুষের স্রোত আমার ওপর আছড়ে পড়ে। বুঝে হোক কিংবা না বুঝে, আমিও ছুটতে শুরু করলাম। আজ মনে হয়, সেদিন সে সময় যদি দৌড় না দিতাম, তবে পদপিষ্ট হয়েই হয়তো মারা যেতাম।
ধীরে ধীরে সংবিত ফিরে পাই। মনে পড়ে, সাধারণ দর্শক হয়ে আমি এখানে আসিনি। আমি তো সাংবাদিক। অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে তার সংবাদমূল্য বেড়ে যায়। সাংবাদিক হিসেবে তার দায় এড়াতে পারি না।
ভয়ার্ত মানুষ দৌড়ে মূল রাস্তায় যাওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করছিল। আমি দৌড়ে রমনা ভবনের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠি। এতে নিজেকে রক্ষা করা যাবে, ঘটনাও দেখা যাবে। আমি যখন সিঁড়িতে, তখনো কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দ কানে আসছিল। দোতলায় গিয়ে দেখি, অন্য সাংবাদিকেরাও সেখানে। ভয় আর আতঙ্কমিশ্রিত চোখে আমরা একে অন্যের দিকে তাকাই। এরই মধ্যে কেউ একজন বলল, ‘মাথা নিচু করে দেখো।’
হামাগুড়ি দিয়ে দেখলাম, ধোঁয়ার কুণ্ডলী, মানুষের আহাজারি, চিত্কার আর ছুটোছুটিতে একটু আগের প্রাণবন্ত সমাবেশের চেহারাটা পাল্টে গেছে। দেখলাম, ট্রাকের ওপর শেখ হাসিনাকে ঘিরে রেখেছেন কয়েকজন নেতা ও একজন দেহরক্ষী। এর মধ্যে আরও কয়েকটি বিস্ফোরণের আওয়াজ পেলাম। পাশাপাশি শুনতে পেলাম মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। এমন সময় কোথা থেকে আামাদের কাছে ছুটতে ছুটতে এলেন শেখ হাসিনার প্রেসসচিব আবুল কালাম আজাদ। আমরা সবাই তাকে ঘিরে ধরলাম। তবে তা ক্ষণিকের জন্য। আমরা কেউই বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কী করব। একের পর এক বিস্ফোরণের শব্দে আমরা প্রাণভয়ে একবার দৌড়ে বারান্দা থেকে নিরাপদ দূরত্বে যাই, একবার তৃতীয় তলায় যাই, আবার ছুটতে ছুটতে দ্বিতীয় তলায় আসি। এভাবে কতবার যে রমনা ভবনের দোতলা-তিনতলায় ওঠানামা করেছি তা আজ আর মনে নেই। ফাঁকে ফাঁকে শেখ হাসিনার অবস্থা দেখতে বারান্দার খোলা জায়গায়ও এসেছি। প্রচণ্ড ধোঁয়ার কারণে কোনো কিছু ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। একপর্যায়ে দ্রুতবেগে চলে যেতে দেখলাম শেখ হাসিনার গাড়িটিকে।
এ সময় এক সাংবাদিককে দেখলাম মোবাইল ফোনে কাকে যেন চিত্কার করে বলছেন, ‘...ভাই, কেয়ামত হয়ে গেছে।’ আমারও অফিসে ফোন করার কথা মনে পড়ল। মোবাইল ফোনে চেষ্টা করলাম, আমাদের তখনকার প্রধান প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার। তাকে না পেয়ে বার্তা সম্পাদককে চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ হয়ে সম্পাদককে প্রাণান্ত চেষ্টা করি। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হচ্ছি। প্রচণ্ড উত্তেজনা আর ভয়ে ঠিকমতো মোবাইলের বোতাম চাপতে পারছিলাম কি না, বলতে পারব না। যা হোক, একপর্যায়ে প্রধান প্রতিবেদককে পেয়ে যাই। কিন্তু তাকে কী বলেছিলাম আজ মনে নেই। বোধ করি, আমার গলাফাটানো চিত্কার শুনে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে-এ রকম কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিলেন তিনি।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার কাজ। ছবি: জিয়া ইসলাম
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার কাজ। ছবি: জিয়া ইসলাম

এদিকে ১২-১৩ বার বিস্ফোরণের শব্দের পর হঠাত্ করেই পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ শুরু করে। রমনা ভবনের দোতলার যেদিকটায় আমরা ছিলাম, সেখানেও কয়েকটা শেল এসে পড়ল। ধোঁয়ায় গোটা এলাকা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। গ্যাসের ঝাঁঝে চোখ জ্বলছে। রমনা ভবনের দক্ষিণ প্রান্তের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলাম। কয়েকজন সহকর্মীর নিষেধ এড়িয়ে জিরোপয়েন্ট আর গোলাপশাহ মাজার বরাবর রাস্তার মাঝখানে গেলাম। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম আরও সামনে। বঙ্গবন্ধু এভিনিউর পশ্চিম প্রান্তে গিয়ে যা দেখলাম, তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
রক্তাক্ত রাজপথ। ছিন্নভিন্ন দেহ। চারদিক থেকে ভেসে আসছে গোঙানির শব্দ। ট্রাকের বাঁ পাশে আওয়ামী লীগের নেত্রী আইভি রহমান পড়ে আছেন। তার নিথর দেহ দেখে মনে হলো তিনি মারা গেছেন। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছেন আরও কয়েকজন নারী। তারা আহত, না নিহত, বোঝার উপায় নেই। ট্রাকের ডান পাশে ক্ষতবিক্ষত মানুষের সারি। তাদের কেউ কেউ সাহায্যের জন্য অতিকষ্টে রক্তাক্ত হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ চিত্কার করে কিছু বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। এরই মধ্যে বেশ কিছু টোকাইকে রাস্তায় পড়ে থাকা শত শত স্যান্ডেল কুড়িয়ে নিয়ে যেতে দেখলাম।
প্রাথমিক আঘাত সামলে উঠে ততক্ষণে অনেকেই উদ্ধারকাজে এগিয়ে এসেছেন। তারা আহত অনেককে ধরাধরি করে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে নিয়ে যান। একপর্যায়ে পুলিশ ও সাংবাদিকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কেউ একজন এসে বললেন, অদূরে অবিস্ফোরিত একটি গ্রেনেড পড়ে আছে। গিয়ে দেখি, যেখানটায় আমি প্রথম দাঁড়িয়েছিলাম, পেট্রলপাম্পের সেই গলির মুখেই গ্রেনেডটি পড়ে আছে।
এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের ক্ষুব্ধ কিছু কর্মী ভাঙচুর শুরু করেন। দুরুদুরু বুকে এদিক-ওদিক ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকি। মোবাইলে ফোন করে অনেকেই ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইছিলেন। কাউকেই কিছু বলতে পারছিলাম না। মনে পড়ে, সেই ভয়াল পরিবেশে এক আপনজনের ফোন পেয়ে কেঁদে ফেলেছিলাম। অফিসের আরও কয়েকজন সহকর্মী ঘটনাস্থলে এলে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা কি পৌনে সাতটার দিকে আমি অফিসের উদ্দেশে রওনা হই।

আহত আইভি রহমানসহ কয়েকজন। ছবি: ছবি: জিয়া ইসলাম
আহত আইভি রহমানসহ কয়েকজন। ছবি: ছবি: জিয়া ইসলাম

নৃশংসতা সহ্য হয় না আমার। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়েও আগে কখনো এ রকম সভা-সমাবেশে হামলা বা বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা দেখতে হয়নি। পশু জবাই আর মাংস কাটার দৃশ্য দেখতে হবে বলে এখনো কোরবানিস্থলের ধারেকাছে যাই না। আর সেই আমি পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ রকম একটি ভয়াবহ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে গেলাম! স্বাভাবিকভাবেই এ ঘটনায় প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পাই। প্রতিবেদক হিসেবে অফিসে এসে আমার প্রথম দায়িত্বই হচ্ছে এ ঘটনার প্রতিবেদন তৈরি করা। কতটুকু নোট নিয়েছিলাম জানি না, তবে পুরো ঘটনাই আমার চোখের সামনে ভাসছিল। কিন্তু কম্পিউটারে বসে কি-বোর্ডে হাত রাখলেও ইন্ট্রো লেখার পর প্রতিবেদন আর এগোচ্ছিল না। বার্তা সম্পাদক বিষয়টি বুঝতে পেরে এক সহকর্মীকে ডেকে বললেন, আমার কাছ থেকে শুনে প্রতিবেদন তৈরি করতে। আমি ঘটনা বলতে থাকলাম, আর ওই সহকর্মী লিখলেন।
দুই বছর পর আজও যখন সেই দিনের ঘটনা মনে পড়ে, আমি শিউরে উঠি। প্রার্থনা করি, আর যেন কাউকে এ ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি না হতে হয়। আর যেন কোনো ২১ আগস্ট ফিরে না আসে কারও জীবনে।