জড়িতদের রক্ষায় বারবার সাজানো তদন্ত

গ্রেনেড হামলায় ধ্বংসস্তূপ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। ছবি: জিয়া ইসলাম
গ্রেনেড হামলায় ধ্বংসস্তূপ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। ছবি: জিয়া ইসলাম


(২১ আগস্ট, ২০০৮ সালে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন। বানানরীতি ও অন্যান্য বিষয় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।)

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় শুরু থেকেই হোতাদের আড়াল করতে তদন্তের গতি ভিন্ন খাতে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তদন্তের নামে বিভিন্ন সময় নানা ‘আষাঢ়ে গল্প’ হাজির করে প্রথম থেকেই বিষয়টিকে বিতর্কিত করার কাজ শুরু হয় সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে তত্কালীন জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরসহ একটি মহলের প্রভাব কাজ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। 

২০০৪ সালে ২১ আগস্ট হামলার দিনই পুলিশ বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় একটি মামলা করে। প্রথমে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখাকে (ডিবি)। কয়েক দিন পর মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডিতে স্থানান্তরিত হয়।
ক্ষমতায় থাকা বিএনপি ঘটনার গুরুত্বকে নষ্ট করতে হামলার শিকার আওয়ামী লীগের দিকেই সন্দেহের আঙুল তোলে। আওয়ামী লীগও ভয়ঙ্কর এই হামলার জন্য বিএনপিকে দোষারোপ করে বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে শুরু করে। ঘটনার পরদিনই শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের বলেন, হামলার সঙ্গে সরকার জড়িত। জোট সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও নেতা তাঁদের বক্তৃতায় আওয়ামী লীগ নিজেরাই জড়িত বলে প্রচার চালান। হামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত বলেও তখন একটা মহল থেকে প্রচার চালানো হয়।
পার্থকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন: ২০০৫ সালের ২৩ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিয়ে প্রথম আলোতে একটি ই-মেইল আসে। সেই ই-মেইল পাঠানোর অভিযোগে ওই বছরের ২৫ আগস্ট শৈবাল সাহা পার্থ নামের এক যুবককে ধরে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পার্থ যেহেতু ভারতে লেখাপড়া করেছেন, তাই তাঁকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার চর হিসেবে প্রমাণের জন্যও তখন অসামরিক একটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে প্রচার চালানো হয় এবং জোট সরকারের সমর্থক বিভিন্ন গণমাধ্যমে তা প্রচার করা হয়। গ্রেনেড হামলায় পার্থ জড়িত বলে প্রমাণ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নানা তোড়জোড় চালায়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে জামিন পেয়ে সাত মাস পর কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন পার্থ। পার্থ জানান, তাঁকে টানা পাঁচ দিন চোখ বেঁধে রাখা হয়। তাঁকে ব্যাপক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে ধানমন্ডি থানায় সোপর্দ করা হয়। জানা গেছে, ওই পাঁচ দিন পার্থ ওই অসামরিক গোয়েন্দা সংস্থার হেফাজতে ছিলেন। ২১ আগস্ট মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টায় ওই সংস্থার তখনকার শীর্ষ কর্তারাও জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ আছে।
মগবাজারের আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেপ্তার: ঢাকার মগবাজার এলাকার সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা মোখলেছুর রহমানকেও এই মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়। তাঁকে দুই দফা রিমান্ডেও নেওয়া হয়। পরে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি অভিযোগ করেন, সিআইডি পুলিশ গ্রেনেড হামলায় তাঁকে জড়াতে না পেরে সাক্ষী হওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিল।
জজ মিয়া উপাখ্যান: কিছুদিন পর দৃশ্যপটে হাজির করা হয় ‘জজ মিয়া উপাখ্যান’। ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বীরকোট গ্রামের বাড়ি থেকে জজ মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে সিআইডি আটক করে। ১৭ দিন রিমান্ডে রেখে জজ মিয়ার কাছ থেকে সিআইডি সাজানো জবানবন্দি আদায় করে। ২৬ জুন আদালতে ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ দেন জজ মিয়া। একইভাবে ওই বছরের নভেম্বরে আবুল হাসেম রানা ও শফিক নামের আরও দুই যুবকের কাছ থেকে প্রায় একই রকম সাজানো জবানবন্দি আদায় করা হয়। এই জজ মিয়াকে দিয়েই গ্রেনেড হামলার ঘটনায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করে তদন্তের নামে ‘আষাঢ়ে গল্প’ প্রচার করেছিলেন মামলার তত্কালীন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির এএসপি আবদুর রশিদ ও তত্কালীন বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন।
সিআইডির এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনিও এই সাজানো ছকে কথিত তদন্তকে এগিয়ে নিয়ে যান। এই গল্প সাজানোর ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তাদের তত্কালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া সেই সাজানো জবানবন্দিতে জজ মিয়া বলেছিলেন, তিনি আগে কখনো গ্রেনেড দেখেননি; গ্রেনেড ও বোমার মধ্যে পার্থক্য তিনি জানেন না। পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বড় ভাইদের নির্দেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড হামলায় অংশ নেন। আর বড় ভাইয়েরা হচ্ছে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ, মুকুল প্রমুখ। এই সাজানো গল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ এটা। উল্লিখিত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বেশির ভাগ জোট সরকারের সময় ভারতে পালিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এরা তত্কালীন ক্ষমতাসীন কোনো কোনো নেতার আনুকূল্যে ছিলেন বলে প্রচার আছে। জজ মিয়া গল্পের মাধ্যমে এই সন্ত্রাসীদের নাম আলোচনায় এনে ২১ আগস্টের হামলার জন্য দায়ী হিসেবে আওয়ামী লীগের দিকে ইঙ্গিত করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।
আর প্রকাশ্য রাজনীতির মাঠে ওই হামলার পর থেকেই তত্কালীন জোট সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীসহ বিএনপি-জামায়াতের প্রথম সারির নেতারা নানা সভা-সমাবেশে হামলার জন্য আওয়ামী লীগকে দোষারোপ বা ইঙ্গিত করে বক্তব্য দেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল-জোট সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এবং দেশকে অস্থিতিশীল করতে এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী আওয়ামী লীগ নিজে।
কে এই জজ মিয়া: নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বোকারপাড় ইউনিয়নের বীরকোট গ্রামের মৃত আবদুর রশিদের দ্বিতীয় সংসারের ছেলে জজ মিয়ার জন্ম ঢাকার তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়ায়। বাবার ভাঙ্গারি ব্যবসার সুবাদে তারা পরিবারের সবাই প্রথমে সেখানকার তিব্বত বস্তি এবং পরে নাখালপাড়া নূরানী মসজিদের পাশে থাকত। বাবার মৃত্যুর পর পঞ্চম শ্রেণী পাস জজ মিয়ার পড়াশোনা আর হয়নি।
বাবার মৃত্যুর পর কিছুদিন বড় ভাই আলমগীরসহ বাবার ভাঙ্গারি ব্যবসা দেখাশোনা শুরু করেন, পরে সেনবাগ গ্রামের বাড়িতে চলে যান জজ মিয়া। জজ মিয়ার মা জানান, পরে জজ মিয়া ঢাকার গুলিস্তানে হকারের কাজ করত। ঢাকায় ও গ্রামের বাড়িতে দুই জায়গায়ই থাকত।
জজ মিয়ার ওই সাজানো জবানবন্দি নিয়ে তখনই গণমাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছিল। আওয়ামী লীগ বলেছিল, তাদের ওপর দোষ চাপানোর কৌশল হিসেবেই এই স্বীকারোক্তি আদায়ের কথা বলা হচ্ছে।
এ ঘটনার প্রায় দুই বছর পর ২০০৬ সালের আগস্টে এই নাটকের পেছনের ঘটনা ফাঁস করে দেন জজ মিয়ার মা জোবেদা খাতুন। তিনি প্রথম আলো ও একটি বেসরকারি টেলিভিশনে সাক্ষাত্কারে বলেন, জজ মিয়াকে গ্রেপ্তারের পর থেকে সিআইডি তাঁর পরিবারকে মাসে মাসে ভরণ-পোষণের টাকা দিয়ে আসছে। জজ মিয়াকে গ্রেনেড হামলা মামলায় রাজসাক্ষী করতে সিআইডির প্রস্তাবের কথাও ফাঁস করে দেন তিনি।
২০০৬ সালের ২১ আগস্ট এই খবর প্রথম আলোতে প্রকাশ হওয়ার পর সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিনের কাছ থেকে জজ মিয়ার পরিবার মাসে মাসে যে টাকা পেত, তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে এই মামলার সুষ্ঠু তদন্তের উদ্যোগ নেয়। সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার ফজলুল কবির দীর্ঘ তদন্ত শেষে গত ১১ জুন এ-সংক্রান্ত মামলা দুটির অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেন। এতে হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি হান্নান ও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তাঁর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়েছে। একই সঙ্গে জোট সরকারের আমলে গ্রেপ্তার করা জজ মিয়া, পার্থসহ ২০ জনের অব্যাহতি দেওয়া হয়।
মামলা ভিন্ন খাতে নেন তিন সিআইডি কর্মকর্তা: এ মামলাটি সর্বমোট পাঁচজন কর্মকর্তা তদন্ত করেন। শুরুতে মতিঝিল থানার দারোগা আমির হোসেন ও ডিবির ইন্সপেক্টর শামসুল ইসলাম অল্প কিছুদিন তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন। সিআইডিতে স্থানান্তরের পর প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন এএসপি আবদুর রশিদ, পরে তদন্ত করেন এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান।
সূত্র জানায়, মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিনের তত্ত্বাবধানে আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিক এ মামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেন। তাঁরা মূল হোতাদের আড়াল করতে জজ মিয়ার গল্প ফাঁদেন। ওই সময় তাঁরা মোট ২০ জনকে গ্রেপ্তার করেন। সিআইডির প্রধান জানান, বর্তমান তদন্তে এসব জবানবন্দির কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
সর্বশেষ এএসপি ফজলুল কবির তদন্ত করে অভিযোগপত্র দেন। অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়ার পর ওই দিন বিকেলে সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (সিআইডি) জাবেদ পাটোয়ারী বলেছিলেন, অতীতে মামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার সঙ্গে জড়িত সাবেক তিন তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই তিন কর্মকর্তা অবসরে চলে গেছেন।
ইন্টারপোল ও এফবিআই: হামলার পর আন্তর্জাতিক পুলিশি সংস্থা ইন্টারপোল ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের বিশেষজ্ঞরাও ঢাকা আসেন। তাঁরা মূলত বিস্ফোরণ ও বিস্ফোরকের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছেন। কিন্তু তত্কালীন জোট সরকার বিষয়টি এমনভাবে প্রচার করে, যেন ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত হচ্ছে-জনমনে এমন ধারণা সৃষ্টি হয়।
তবে জোট সরকার আমলে তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইডির একটি সূত্র জানায়, এফবিআই তাদের মতামতে এই হামলায় আর্জেস গ্রেনেড ব্যবহার হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে এবং তারা জানায়, অস্ট্রিয়ার বাইরে পাকিস্তানেও এই গ্রেনেড তৈরি হয়।