শেখ হাসিনাকে চারবার হত্যার চেষ্টা চালায় হরকাতুল জিহাদ

সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। ছবি: জিয়া ইসলাম
সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। ছবি: জিয়া ইসলাম


(২১ আগস্ট, ২০০৮ সালে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন। বানানরীতি ও অন্যান্য বিষয় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।)

চার বছর আগে ঢাকায় এক ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালায় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী-হুজি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমান হত্যা এবং কারাগারে চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ডের পর দেশে এটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা ও হত্যাযজ্ঞ। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে জনসমাবেশের ওপর এই গ্রেনেড হামলা হয়। এর আগে আরও অন্তত তিনবার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল ধর্মের নামে তত্পর গোপন জঙ্গি সংগঠনটি। 

শেখ হাসিনাকে হত্যার প্রথম চেষ্টা হয়েছিল তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ২০০০ সালে। গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় ওই চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ২০০১ সালে খুলনায়, একই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে সিলেটে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল একই জঙ্গি গোষ্ঠী।
হুজির অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, ২০০০ সালের জুলাই মাসে হুজির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে শেখ হাসিনাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। ওই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছর ২০ জুলাই কোটালিপাড়ায় শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য তাঁর সমাবেশস্থল ও হেলিপ্যাডের কাছে দুটি শক্তিশালী বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল, যা সমাবেশের আগে পুলিশ উদ্ধার করে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, কোটালিপাড়ায় বোমা পোঁতার এক সপ্তাহ আগে হুজি দূরনিয়ন্ত্রিত বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল ফরিদপুরে পীর আলাল চিশতির বাত্সরিক জলসায়। ২০০০ সালের ১৩ জুলাই ওই বোমা হামলায় একজন নিহত ও সাতজন আহত হয়। ফরিদপুরের ওই হামলায় সফল হওয়ার পর একই প্রযুক্তিতে আরও কয়েকগুণ শক্তিশালী দুটি বোমা পোঁতা হয়েছিল কোটালিপাড়ায় শেখ হাসিনার সমাবেশস্থল ও হেলিপ্যাডের কাছে। সমাবেশের আগেই সে বোমা উদ্ধার হয়ে যায়। মূলত ওই ঘটনার পরই এই ঘটনার হোতা হুজি নেতা মুফতি হান্নানের নাম প্রচার পায়।
কিন্তু ফরিদপুরের আলাল চিশতির জলসায় হামলার মামলাটি ছিল মুফতি হান্নানের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া প্রথম মামলা (ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার মামলা নম্বর ১৮, তারিখ-১৩.০৭. ২০০০)। ওই মামলায় মুফতি হান্নানসহ ছয় আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠনও হয়েছিল।
বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা’ দেখিয়ে এই মামলার প্রধান আসামি হুজি নেতা হাফেজ মুফতি কামাল উদ্দিন শাকের ও ফ্রিডম পার্টির সাবেক কর্মী নবাব শরিফের নাম প্রত্যাহার করা হয়। এর ফলে মুফতি হান্নানসহ অন্য আসামিরাও মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে যান।
ওই বোমা হামলার আগে মুফতি হান্নান নিজে ঘটনাস্থল আক্রমণপূর্ব পর্যবেক্ষণ (রেকি) করেছিলেন। শেখ মো. শাহ আলী ওরফে আলাল চিশতি গত ২৩ মার্চ এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘জলসায় বোমা হামলার চার দিন আগে সন্ধ্যার পর মুফতি হান্নান আমার খানকায় আসেন। তিনি আমাকে বললেন, তিনি নাকি আধ্যাত্মিক সাধকদের পছন্দ করেন। তাই এসেছেন। আমি বললাম, আপনি মুফতি মানুষ, এসব লাইন পছন্দ করেন নাকি? মুফতি হান্নান বললেন, তিনি খাজা বাবার ভক্ত। তারপর তিনি চোখ বন্ধ করে ধ্যান করার মতো কিছুক্ষণ বসলেন। আমি তাঁকে আনারস কেটে খাওয়াই।’
চিঠির সূত্র ধরে রহস্য উন্মোচন: তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা যায়, আলাল চিশতি জলসায় বোমা হামলার এক সপ্তাহ পর এই মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ফরিদপুর সদর থানার তত্কালীন উপপরিদর্শক এম এ ছালাম তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর উপলক্ষে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় যান। সেখানে শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলের কাছ থেকে ৬৩ কেজি বোমা উদ্ধারের পর মুফতি হান্নানের সাবান কারখানায় (কোটালিপাড়ায়) তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ বিভিন্ন সামগ্রীর মধ্যে কয়েকটি চিঠিও পায়। একটি চিঠিতে লেখা ছিল, ‘মোসাইবকে পাঠালাম, আগামী ১৩ / ০৭ / ২০০০ তারিখে ফরিদপুরের দরবার শরীফের প্রোগ্রামের জন্য স্পট পরিদর্শন দরকার। ছামান তৈরি রাখবেন। ইতি শাকের।’ আরেকটিতে লেখা, ‘মোসাইবকে দিয়ে তিন হাজার টাকার সামান্য তোফা পাঠালাম, হয়ত সামান্যই উপকারে আসবে। ইতি শাকের, ফরিদপুর।’
কোটালিপাড়ার বোমা মামলার ঘটনা তদন্ত করতে চিঠি দুটির সূত্র ধরে পুলিশ শাকেরের সন্ধানে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার এক মাদ্রাসায় অভিযান চালায়। সেখানে আটক একজন মাওলানা জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানান, ফরিদপুরের খন্দকার মহসিনের ছেলে মুফতি হাফেজ খন্দকার কামাল উদ্দিনের ছদ্মনাম শাকের। এরপর আত্মগোপনে থাকা শাকেরকে ফরিদপুরে তাঁর বাড়ির কাছে এক মাদ্রাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২০০০ সালের ১ আগস্ট গোপালগঞ্জ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে কোটালিপাড়ার বোমা মামলায় শাকের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে শাকের স্বীকার করেন, ওই চিঠি দুটি তাঁরই লেখা। মোসাইব ওরফে রাসু ও নবাবের মাধ্যমে তিনি মুফতি হান্নানের কাছে চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন। তিনি জানান, ‘ছামান’ বলতে তাঁরা বোমা বোঝান।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানায়, এই জবানবন্দির পরই ফরিদপুর পুলিশ জানতে পারে আলাল চিশতির জলসায় বোমা হামলা চালিয়েছে হুজি। পরে ফরিদপুরের মামলায় শাকেরকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদে শাকের পুলিশকে বলেছিলেন, মুফতি হান্নানের পরিকল্পনায় তাঁরা ওরসের নামে বেদাতি কাজ ও গান-বাজনা বন্ধ এবং শেখ হাসিনার ওপর হামলা করতে তাঁদের তৈরি করা দূরনিয়ন্ত্রিত বোমা পরীক্ষা করার জন্য এই হামলা চালিয়েছিলেন।
যেভাবে পরীক্ষামূলক হামলা হলো: ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার এই সংক্রান্ত মামলার [নম্বর ১৮ (৭) ২০০০] নথিপত্রে দেখা যায়, কোটালিপাড়া বোমার ঘটনায় গোপালগঞ্জ থানার একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ২০০০ সালের ১ আগস্ট গোপালগঞ্জের ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফরিদপুর শহরের ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান শাকের। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, আলাল চিশতির জলসায় বোমা হামলার মাস তিনেক আগে মুফতি হান্নানের ডাক পেয়ে তিনি রাসু ও নবাব কোটালিপাড়ার হিরণ গ্রামে যান। সেখানে হান্নানের সোনার বাংলা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে (সাবান কারখানা) মুফতি হান্নান তাঁদের সঙ্গে দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন।
শাকের বলেন, এর কিছুদিন পর মুফতি হান্নান ও তাঁর সহযোগী আবু মুসা (বাগেরহাট) ও হারুন (ফেনী) ফরিদপুরে তাঁর কাছে যান। তাঁরা বোমা তৈরি ও অন্যান্য খরচের জন্য শাকেরের কাছে কিছু টাকা চান। কিছুদিন পর দুই দফায় রাসুকে চিঠিসহ মুফতি হান্নানের কাছে পাঠান তিনি। দ্বিতীয়বার তিন হাজার টাকাও পাঠান শাকের।
আদালতে জবানবন্দিতে শাকের বলেন, ২০০০ সালের ১৩ জুলাই জোহরের নামাজের পর তাঁর কাছে একটি বোমাসহ হাসান ও রাসু যান। তিনি তাঁদের জলসার মঞ্চের কাছে অবস্থা বুঝে বোমা পোঁতার নির্দেশনা দেন। ওই দিন সন্ধ্যা সোয়া সাতটার দিকে নবাব, হাসান ও রাসু বোমা নিয়ে জলসায় যান। রাসু বোমাটি পুঁতে রেখে সুইচ টিপে সরে পড়েন এবং ছয় মিনিট পর তা বিস্ফোরিত হয়।
এই মামলার তদন্ত শেষে বোমা হামলার পরিকল্পনা, প্রস্তুতি ও আক্রমণে জড়িত হুজির অন্যতম শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, মুফতি হাফেজ খন্দকার কামাল উদ্দিন শাকের, তাঁর সহযোগী মোসাইব হাসান ওরফে রাসু, ফ্রিডম পার্টির সাবেক কর্মী নবাব শরীফসহ ছয়জনকে অভিযুক্ত করে ২০০১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। ২০০২ সালের ৫ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করা হয়। আসামিদের মধ্যে নবাব, রাসু ও মুফতি হান্নান এই মামলায় কখনো গ্রেপ্তার হননি। এর মধ্যে রাসু গত বছর রোজার মাসে অসুস্থ হয়ে মারা যান। শাকের ২০০৬ সালের শেষ দিকে সৌদি আরব চলে গেছেন বলে পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে জঙ্গিরা মুক্ত: মামলার রায়ের আদেশে ও নথিপত্রে দেখা যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন শাখা থেকে ২০০২ সালের ৪ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে দেওয়া এক নির্দেশে বলা হয়, ‘মূলত রাজনৈতিক কারণে হয়রানিমূলক ফরিদপুর কোতয়ালি থানার মামলা নং ১৮ (৭) ২০০০ থেকে আসামী হাফেজ মাওলানা মুফতি খন্দকার কামাল উদ্দিনের (শাকের) নাম প্রত্যাহার করার জন্য সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।’ এ ব্যাপারে সরকারি কৌঁসুলির মাধ্যমে ব্যবস্থা নিয়ে এর ফলাফল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানাতে বলা হয়। ২০০৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয় থেকে একইভাবে নির্দেশ দিয়ে ওই মামলার আরেক আসামি নবাব শরীফের নাম প্রত্যাহার করা হয়।
আদালতের রায়ে আরও বলা হয়, প্রধান আসামি কামাল উদ্দিন শাকেরের নাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় তাঁর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদালত বিবেচনায় নিতে পারেননি। ফলে বাকি আসামিদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি। ২০০৫ সালের ১৬ মে আদালত বাকি আসামিদের খালাস দেন।
মামলার বাদী আলাল চিশতি জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসামিদের করা দরখাস্তে বিএনপির জেলা সভাপতি জহিরুল ইসলাম শাহজাদা এবং ওই অঞ্চলে বাড়ি সাবেক জোট সরকারের একজন মন্ত্রী সুপারিশ করেছিলেন।
জহিরুল ইসলাম শাহজাদা গত মে মাসে টেলিফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘এটা অনেক দিন আগের কথা, এখন আমার মনে নাই সুপারিশ করেছিলাম কি না।’
সিলেটে হত্যাচেষ্টা: জোট সরকারের আমলে (২০০৬ সালের ১৯ নভেম্বর) আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে মুফতি হান্নান বলেন, ‘২০০১ সালে (তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে) আমাদের সংগঠনের কর্মী সিলেটের জাফর (ফেঞ্চুগঞ্জ)-এর মাধ্যমে জানতে পারি যে, শেখ হাসিনা নির্বাচনী জনসভা করার জন্য সিলেটে যাবেন। তাঁর জনসভায় বোমা পাতার জন্য আলোচনা হয়। উক্ত আলোচনা মোহাম্মদপুর (ঢাকা) নূরানী মাদ্রাসার অফিসের সামনে হয়। আলোচনায় আমি ছাড়াও মওলানা আবু সাইদ (গফরগাঁও), আবু মুসা, লোকমান (খুলনা), আবু বকর (সিলেট), ডালিম (চট্টগ্রাম), ওবায়দুল্লাহ হারুন (ফেনী), নুর ইসলাম (খুলনা) ছাড়াও কয়েকজন উপস্থিত ছিল। আলোচনাক্রমে শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা হামলা করে তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত হয় এবং উক্ত কাজের জন্য বোমার সরঞ্জাম সংগ্রহ করে সিলেটে নেবার দায়িত্ব দেওয়া হয় মওলানা সাইদ, আবু মুসা, লোকমান, আবু বকর ও ডালিমকে। তাদের সাথে মাওলানা আবু সাঈদ, নুর ইসলাম, ওবায়দা (ফেনী) ও আরো ২ / ১ জন যায়।’
প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনার পরবর্তী ওয়াকিবহাল সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে ও মামলার নথিপত্র পর্যালোচনায় জানা যায়, ২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর রাত আটটার দিকে সিলেট শহরে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে আওয়ামী লীগের জনসভাস্থল থেকে কাছাকাছি ফাজিল চিশত এলাকায় ড. আরিফ আহমেদ রিফার ভাড়া দেওয়া মেস ঘরে বোমা বানানোর সময় বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে দুই বোমাবাজ নিহত হয়। আহত অবস্থায় হুজি সদস্য মাসুদ আহমেদ শাকিল (ঢাকা) ও আবু ওবায়দা ওরফে হারুন (ফেনী) গ্রেপ্তার হন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে শাকিল জানান, ঘটনাস্থল থেকে আকাশ, রাজু, অমিত, সবুজ ও আলমগীরসহ আরও কয়েকজন পালিয়ে যায়।
এ সংক্রান্ত মামলায় [সিলেট কোতোয়ালি থানা মামলা নং ৬৩ (৯) ২০০১] ২০০১ সালেই আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে শাকিল ঘটনার বিবরণ দেন। কিন্তু কিছুদিন পর পুরো বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়। ২০০৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি মাদ্রাসা থেকে মুফতি হান্নানের ‘গুরুখ্যাত’ মাওলানা আবু সাইদ ওরফে আবু জাফরকে গ্রেপ্তারের পর এই বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। মাওলানা আবু সাইদ ২০০৬ সালের ৫ অক্টোবর সিলেট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জবানবন্দি দিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টার কথা স্বীকার করেন। জবানবন্দিতে বলা হয়, ২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরের মধ্যে শেখ হাসিনার হজরত শাহজালালের (রহ.) মাজারে যাওয়ার কথা ছিল। পরে তাঁরা খবর পান, হাসিনা হজরত শাহপরানের (রহ.) মাজারে যাবেন। দুই মাজারে ওত পেতে থাকার পর সন্ধ্যায় জানতে পারেন, হাসিনা সরাসরি জনসভাস্থলে চলে যাবেন। এরপর জঙ্গিরা জনসভাস্থলের অদূরে তাদের ভাড়া করা মেসে গিয়ে ওঠে। ওই মেসেই রাত আটটার দিকে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে বোমা বিস্ফোরিত হয়। ঘটনাস্থলেই আবু মুসা ও লোকমান নামের দুই জঙ্গি নিহত হন। এর মধ্যে আফগান রণাঙ্গনে বোমার ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুসার বাড়ি বাগেরহাটের সোনাতলায় (মংলা রোড)।
এই মামলার নথিপত্র ও জঙ্গিদের জবানবন্দি পর্যালোচনা করে তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, সিলেটে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করে আগ থেকেই জঙ্গিরা স্থানীয় একটি ফটো কালার ল্যাবে চাকরি নেয়। এ ক্ষেত্রে তাদের একজন সরকারি কর্মকর্তা সহায়তা করেছিলেন বলেও জঙ্গিরা আদালতে বলে। ওই কর্মকর্তার অনুরোধে কালার ল্যাবের মালিক তাঁর বাড়ির সামনে ভাড়া দেওয়া মেসে তাদের থাকতে দেয়। কর্মচারী সেজে ওই মেসে বসে জঙ্গিরা শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। ওই পরিকল্পনায় একজন সাবেক পুলিশ সদস্যও যুক্ত ছিলেন, যিনি আগে পুলিশ সদর দপ্তরে কর্মরত ছিলেন।
খুলনায় হত্যা পরিকল্পনা: কোটালিপাড়ায় হত্যার পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর ২০০১ সালের ৩০ মে খুলনায় রূপসা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল হুজি। কিন্তু তিন দিন আগে ২৭ মে সেতুর কাছাকাছি রূপসা নদী থেকে দুটি ইঞ্জিন নৌকাভর্তি ১৫ জঙ্গি ধরা পড়ে যাওয়ায় সেটিও আর সফল হয়নি। এই ১৫ জনের একজন মাসুম বিল্লাহ ওরফে মুফতি মইন ঢাকায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় অংশ নিয়েছিলেন।
স্থানীয় পুলিশ সূত্র ও ২০০১ সালের ৩০ মে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, তালেবান সন্দেহে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের কাছ থেকে সেনাবাহিনীর পোশাক, বুট ও বিভিন্ন কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়। খুলনা সদর থানার পুলিশ তাদের তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তারা পরস্পরবিরোধী তথ্য দেয়।
ওই সময় খুলনা সদর থানায় কর্মরত ছিলেন এমন একজন পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, গ্রেপ্তার হওয়া যুবকেরা শেখ হাসিনার অনুষ্ঠানে নাশকতার পরিকল্পনা করছিল বলে তখন সন্দেহ করা হয়েছিল। তাঁরা যে ধর্মীয় উগ্র গোষ্ঠীর সদস্য, সেটাও পুলিশ অনেকটা নিশ্চিত হয়েছিল। কিন্তু কোনো প্রমাণ না থাকায় ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের বাড়ি ঝিনাইদহ, যশোর, কুষ্টিয়া ও ঝালকাঠি এলাকায়।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, নৌকা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া এই ১৫ জন মুফতি হান্নানের নেতৃত্বাধীন হুজির সদস্য। এঁদের মধ্যে একজন কুতুব উদ্দিন ওরফে বাবুর বাড়ি শৈলকুপা উপজেলার কেষ্টপুর গ্রামে। তিনি ২১ আগস্ট হামলা মামলার দুই আসামি ও হুজি আঞ্চলিক নেতা আবুল কালাম আজাদ বুলবুল ও মাওলানা লিটন ওরফে জোবায়েরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, যা তাঁর বাবা আবদুস ছাত্তার প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেছেন।
এসব তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনাকারী সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে ও অনুসন্ধানে জানা যায়, রূপসা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টার পরিকল্পনা ছিল জঙ্গিদের। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর এই মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। আসামিরা সবাই কিছুদিন পর জামিনে বেরিয়ে যান।
শেখ হাসিনা কেন লক্ষ্য: ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়ার পর ওই দিন ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (সিআইডি) জাবেদ পাটোয়ারী বলেছেন, গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের অনেকেই জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তাঁরা শেখ হাসিনাকে ইসলামের শত্রু মনে করেন। তাঁরা মনে করেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে ইসলামের অনেক ক্ষতি করেছে, তাই হুজি তাঁকে হত্যা করার ব্যাপারে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।