প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়ী করেছে বিচারপতি জয়নুল কমিশন

হতাহত লোকজনকে উদ্ধারের চেষ্টা। ছবি: জিয়া ইসলাম
হতাহত লোকজনকে উদ্ধারের চেষ্টা। ছবি: জিয়া ইসলাম


(২১ আগস্ট, ২০০৮ সালে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন। বানানরীতি ও অন্যান্য বিষয় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।)

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা তদন্তে ২০০৪ সালের ২২ আগস্ট বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে সরকার। মাত্র এক মাস ১০ দিনের মাথায় ওই বছরের ২ অক্টোবর কমিশন সরকারের কাছে ১৬২ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর সরকার আজ পর্যন্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেনি। তদন্ত কমিশনের এই প্রতিবেদনটি প্রথম আলোর কাছে রয়েছে। বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীন বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে কর্মরত আছেন। 

বিচার বিভাগীয় কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় কারা সুবিধাভোগী হতে পারে এবং সম্ভাব্য কারা এমন হামলা চালাতে পারে, তার ওপরও জোর দিয়েছে এই তদন্ত কমিশন। এ পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক ও বর্তমান প্রধানদের সাক্ষাত্কার নিয়ে প্রয়োজনীয় আলামত ও গোয়েন্দা তথ্য এবং সাক্ষ্য সংগ্রহ করে। এসব সাক্ষ্য তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।
বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীন কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, সতর্ক মূল্যায়ন, বিশ্লেষণ ও অপরাপর ঘটনা ও আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে যুক্তিসংগত কারণে হামলায় আওয়ামী লীগের একটি অংশ, বিএনপি ও তার মিত্র জামায়াতে ইসলামী এবং কিছু ধর্মীয় উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর জড়িত থাকার বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিশনের সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণ সন্দেহাতীতভাবে ইঙ্গিত করে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পেছনে একটি শক্তিশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল। অভিযানটি পরিচালনা করা হয়েছিল ভাড়া করা দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে। এসব লোক প্রধানত একটি সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডারদের মধ্য থেকে নেওয়া হয়, যাদের সমাবেশে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়ার মতো ভালো জ্ঞান ছিল। প্রতিবেদনে বিদেশি শক্তি বলতে কোনো দেশের নাম বলা হয়নি। তবে ২০০৪ সালের ৪ অক্টোবর প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক সাক্ষাত্কারে বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীন বৃহত্ প্রতিবেশী শক্তি হিসেবে ভারতকে ইঙ্গিত করেছেন। ওই সাক্ষাত্কারে বিচারপতি জয়নুল বলেন, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাকারীদের চিহ্নিত করেছেন।
বিদেশি শক্তির উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, মনে হচ্ছে, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে একটি বৃহত্ বিদেশি শক্তির সক্রিয় সহযোগিতা ছিল। বাংলাদেশকে তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতেই একটি অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে তারা ওই সহযোগিতা করেছিল। বিদেশি ওই শক্তির গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশে ক্রমশ অনুপ্রবেশ করে। তারা বাংলাদেশে প্রধানত ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষ ও বিপক্ষ ধুয়ো তুলে জনগণের মধ্যে বিভাজন তৈরির উদ্দেশ্যে এ দেশে স্থানীয় কিছু বিশ্বস্ত এজেন্টও তৈরি করে। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ এমন বিভাজনের মাধ্যমে বিদেশি শক্তির ওই অবস্থা আরও শক্তিশালী হয়। আসলে বিদেশি ওই শক্তি কখনো চায়নি বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠুক। কারণ এটি হতে দিলে তারা তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা ও অগ্রাধিকারগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবে না। আর তাই বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাটি তাদের আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে বাংলাদেশে তাদের স্থানীয় এজেন্ট ও ভাড়াটে দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে অনিষ্টকর কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে। তারা তাদের স্বার্থ হাসিলে বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকা অতীত সরকারগুলোকে বাধ্য করতে পারেনি। এ জন্য তারা যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সিরিজ বোমা বিস্ফোরণের সূত্রপাত ঘটায় এবং অতি সম্প্রতি হামলা চালানো হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে। জনগণের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে আওয়ামী লীগকে বিএনপির বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে এবং সারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে এমন পরিকল্পনা করা হয়। ওই গোয়েন্দা সংস্থাটি সাম্প্রতিক সময়ে আরও কিছু বোমা হামলা চালায়, যার উদ্দেশ্য ছিল শরিক বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে জোট সরকারকে দুর্বল করা।
জয়নুল কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই বিদেশি শক্তির গোয়েন্দা সংস্থাটি তাদের অনিষ্টকর পরিকল্পনার পরিণাম বুঝতে ব্যর্থ হয়ে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ সমাবেশে বেপরোয়াভাবে ভয়াবহ হামলা চালায় এবং এতে গ্রেনেডের মতো বিপজ্জনক ও অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা এমন পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না বা এতে তাঁদের কোনো হাতও ছিল না। অতীতের অন্য হামলার মতো আওয়ামী লীগের সমাবেশে এই নৃশংস হামলার প্রত্যাশা ছিল, ঘটনাটি পশ্চিমা বিশ্ব থেকে সমর্থন ও সহানুভূতি আদায় করতে পারবে। কারণ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের দাবি করে আওয়ামী লীগ।
হামলার মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদেশি এ গোয়েন্দা সংস্থাটি আওয়ামী লীগসহ বাংলাদেশের কারোরই বন্ধু নয়। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা এমন একটি ঘটনা ছিল, যাতে আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা এবং দলের অন্য নেতারাও নিহত হতে পারতেন। আসলে এমন উদ্দেশ্য হাসিল করাই ছিল বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাটির উদ্দেশ্য। কিন্তু ভাড়া করা দুর্বৃত্তরা তাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে ব্যর্থ হয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, আওয়ামী লীগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল পুরো অভিযানে। এটি সম্ভব হলে বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটত এবং পরিণতিতে বর্তমান জোট সরকারের পতন হতো, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটতে পারত। এ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তারা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে একটি পুতুল সরকার বসাত।
এ প্রসঙ্গে বিচারপতি জয়নুল কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আবার এই লক্ষ্য অর্জনে তারা ব্যর্থ হলেও বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে ব্যর্থ বা অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস চালাত। এদিকে গোয়েন্দা সংস্থাটির কিছু সংবাদপত্র সাংবাদিকতা কিংবা পেশাগত নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে সংস্থাটির পরিকল্পনার সমর্থনে অপপ্রচার চালিয়েছে। পরিকল্পনার সমর্থনেও কাজ করেছে। ওই অপপ্রচারের উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করা, যেখানে বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণ নেওয়া যায় এবং তার ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। এ ক্ষেত্রে যুক্তি দেখানো হতো, বিশ্বের যেকোনো অংশে ব্যর্থ রাষ্ট্রগুলো তাদের প্রতিবেশীদের জন্য তো বটেই, বিশ্বের জন্যও হুমকির শামিল।
কমিশনের অপ্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে দেখা যায়, তদন্তকালে কমিশন সবগুলো গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, সাংবাদিক, কলাম লেখক, প্রত্যক্ষদর্শী, আহত ব্যক্তিসহ ১২৩ জনের সাক্ষ্য নেন। এ ছাড়া ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামতও সংগ্রহ করেন কমিশন।