যারা যেভাবে পরিকল্পনা ও হামলা করেছিল

উদ্ধার করে হাসপাতালের পথে। ছবি: জিয়া ইসলাম
উদ্ধার করে হাসপাতালের পথে। ছবি: জিয়া ইসলাম


(২১ আগস্ট, ২০০৮ সালে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন। বানানরীতি ও অন্যান্য বিষয় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।)

চার বছর আগে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী-হুজির জঙ্গিরা। মুফতি হান্নানের নির্দেশনায় ওই আক্রমণে সরাসরি অংশ নেয় প্রশিক্ষিত ১২ জঙ্গি। হামলায় মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২২ জন নিহত হন। আহত হয় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রায় তিন শ নেতা-কর্মী-সমর্থক। 

নারকীয় ওই হামলার পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তত্কালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু। পিন্টুর ভাই হুজি নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন এই আক্রমণের জন্য আর্জেস গ্রেনেড সরবরাহ করেছেন বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।
মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইডি সূত্রগুলো জানায়, মুফতি আবদুল হান্নানসহ গ্রেপ্তার হওয়া তাঁর ভাই ও হুজি নেতা মফিজুর রহমান ওরফে অভি, আবুল কালাম আজাদ বুলবুল (ঝিনাইদহ), শরিফ শহিদুল ইসলাম ওরফে বিপুল (সিলেট), মাওলানা আবু সাইদ ওরফে ডা. আবু জাফর (গফরগাঁও), জাহাঙ্গীর আলম (কুষ্টিয়া), হোসাইন আহমেদ ওরফে তামীম (ঝিনাইদহ), আরিফ হাসান ওরফে সুমন (ঢাকা), রফিকুল ইসলাম গাজী ওরফে সবুজকে (মাগুরা) জিজ্ঞাসাবাদ, আদালতে দেওয়া তাঁদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও অন্যান্য তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সিআইডি নিশ্চিত হয়েছে, শেখ হাসিনাসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করাই ছিল ওই আক্রমণের মূল লক্ষ্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর এটা ছিল আওয়ামী লীগের ওপর সবচেয়ে পরিকল্পিত ও বড় আঘাত।
২০০৫ সালের ১ অক্টোবর মুফতি হান্নানকে ঢাকার বাড্ডা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেলসহ মামলার তদন্তকারীদের কাছে তিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা ও তা কারা কীভাবে কার্যকর করেছে, তার বিবরণ দেন।
পরিকল্পনা ও হামলা হয় যেভাবে: মুফতি হান্নানসহ জঙ্গিদের দেওয়া তথ্য ও গোয়েন্দা সূত্রমতে, ২০০০ সালে হুজির মজলিশে শুরার সভায় শেখ হাসিনাকে হত্যার সিদ্ধান্ত হয়। জিজ্ঞাসাবাদে মুফতি হান্নান জানান, সেই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ১৯ আগস্ট সন্ধ্যার দিকে রাজধানীর পশ্চিম বাড্ডায় একটি বাসায় সংগঠনের সদস্য আহসান উল্লাহ কাজল (যশোর), আবু জান্দাল, ফরিদপুরের মুরসালিন ও মুত্তাকিন, খুলনার মাওলানা লিটনসহ তিনি বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলার বিষয় আলোচনা হয়। বৈঠক থেকে মুফতি হান্নান টেলিফোনে ফরিদপুরের কামাল উদ্দিন শাকের, আবদুর রহমান (বরিশাল), যশোরের মাওলানা মনিরুল ইসলাম মদিনা, মাওলানা রুস্তম আহমেদ ও মুফতি আরিফ বিল্লাহকে (ঝিনাইদহ) বিষয়টি জানান এবং তাঁদের ঢাকায় আসতে বলেন। অবশ্য তাঁরা ঢাকায় আসেননি। মাওলানা আবু সাইদ (ওরফে ডা. জাফর) সন্ধ্যার পরে এসে ওই বৈঠকে যোগ দেন। পরিকল্পনার কথা শুনে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের হামলার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোক দরকার, কিন্তু এ মুহূর্তে আমার কাছে লোক নেই।’ কাজল জানান, ‘লোক পাওয়া যাবে। এ জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আনস সাহেব ও খেলাফত মজলিসের সাংসদ মুফতি শহিদুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলব।’ পরে কাজল টেলিফোনে আনসের সঙ্গে কথা বলেন এবং এই কাজে (হামলা) তাঁর সহযোগিতা চান। আনস সাহেব তাঁকে তাঁর মোহাম্মদপুরের বাসায় যেতে বলেন। পরদিন কাজল ওই বাসায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন এবং একই দিন মুফতি শহিদুলের সঙ্গেও দেখা করেন।
হামলা পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে পরদিন ২০ আগস্ট সকালে একই বাসায় মুফতি হান্নান, আবু সাইদ, লিটন, কাজল ও আবু বকর (যশোর) আবার বৈঠকে বসেন। কারা কারা হামলায় অংশ নেবে, সেখানে তার তালিকা তৈরি করা হয়। বৈঠকে হামলার জন্য অস্ত্র ও টাকা-পয়সার ব্যবস্থা আছে কি না জানতে চাইলে কাজল জানান, গ্রেনেড আছে। টাকার ব্যবস্থাও হবে।
আদালতে মুফতি হান্নান বলেছেন, এর আগে ওই দিনই তিনি তখনকার উপমন্ত্রী পিন্টুর ধানমন্ডির বাসায় বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজি ঢাকা মহানগর সভাপতি মাওলানা আবু তাহেরও উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে মাওলানা তাজউদ্দিন আক্রমণের জন্য তাঁর কাছে গ্রেনেড হস্তান্তর করেন এবং পিন্টু ২০ হাজার টাকা দেন মুফতি আহসান উল্লাহ কাজলের হাতে।
হামলার আগের দিন ২০ আগস্ট কাজল ও আবু জান্দাল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গিয়ে এলাকা পর্যবেক্ষণ (রেকি) করে আসেন। ২১ আগস্ট সকালে একই বাসায় উল্লিখিত সবাই এবং হামলায় অংশ নেওয়ার জন্য নির্বাচিতরা একত্র হন। সিদ্ধান্ত হয়, মোট ১২ জন হামলায় অংশ নেবে। এতে কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন কাজল ও আবু জান্দাল। এরপর বাড্ডার ওই বাসায় তাঁরা সবাই একসঙ্গে জোহরের নামাজ পড়ে দুপুরের খাবার খান। সেখানে তাঁরা সর্বশেষ বৈঠক করেন। মাওলানা সাইদ জিহাদবিষয়ক বয়ান করেন। তারপর মুফতি হান্নান হামলার জন্য নির্বাচিত ১২ জনের হাতে ১৫টি গ্রেনেড তুলে দেন।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আসরের নামাজের সময়ে সবাই যার যার মতো গিয়ে গোলাপ শাহ মাজারের কাছে মসজিদে মিলিত হয়। সেখান থেকে তারা সমাবেশে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহূত ট্রাকটির চারপাশে অবস্থান নেয়। শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর পর আবু জান্দাল প্রথম গ্রেনেড ছুড়ে মারেন। তারপর অন্যরা একে একে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে যার যার মতো এলাকা ছেড়ে চলে যায়।
এই মামলায় পরে আরও সাত জঙ্গি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক যে জবানবন্দি দিয়েছে, তাতেও হামলা সম্পর্কে এ রকম তথ্য-বক্তব্য উঠে আসে।
এ ছাড়া সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর গ্রেনেড হামলা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি শরিফ শহিদুল ইসলাম ওরফে বিপুলও গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসংক্রান্ত কিছু তথ্য দেন। বিপুলের ভাষ্যমতে, তিনি ২০০৪ সালের ১৯ আগস্ট ঢাকায় মুফতি হান্নানের বাড্ডার বাসায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে তখন হান্নানের ভাই মফিজুর রহমান ওরফে অভি এবং রফিক নামের একজন ছিলেন। তাঁরা ২১ আগস্টের হামলার বিষয়ে পরিকল্পনা করেন। মাগরিবের নামাজের পর ঘণ্টা দেড়েক আলোচনা হয়। এরপর রাতের ট্রেনেই বিপুল সিলেটে চলে আসেন। পরদিন ২০ আগস্ট সকালে অভি ফোনে বিপুলকে বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে হালকা নাশতা করাতে হবে।’ হামলার ঘটনার কয়েক দিন পর বিপুল ঢাকায় এলে অভি তাঁর কাছে হামলার কথা স্বীকার করেন।
গত ১১ জুন অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়ার পর ওই দিনই বিকেলে সিআইডির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (সিআইডি) জাবেদ পাটোয়ারী বলেছেন, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য ওই হামলা চালিয়েছিল জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ, তদন্তে যার প্রমাণ মিলেছে। তিনি বলেন, হুজি নেতা মুফতি হান্নানই গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনাকারী ছিলেন। সাবেক জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু ব্যক্তিগতভাবে এতে জড়িয়ে পড়েন। পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন হুজির নেতা এবং এই আক্রমণের জন্য আর্জেস গ্রেনেড সরবরাহ করেছেন। বিভিন্নজনের জবানবন্দি, পারিপার্শ্বিক ঘটনা ও তথ্য-উপাত্ত থেকে এর প্রমাণ মিলেছে।