এখনো তাড়া করে ফেরে দুঃসহ স্মৃতি

একুশে আগস্টের বর্বর হামলায় আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় নীলা চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
একুশে আগস্টের বর্বর হামলায় আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় নীলা চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

‘একুশে আগস্টের কারণেই আমি দেশছাড়া। চিকিৎসার প্রয়োজনে বিদেশেই আবাস গড়তে হয়েছে। কিন্তু প্রতিনিয়তই দেশ, দেশের মাটি আর রাজনীতি আমাকে টানে। তাই প্রতিবছরই একাধিকবার দেশে ছুটে আসি।’ এভাবেই বলছিলেন নীলা চৌধুরী।

একুশে আগস্টের রক্তাক্ত হামলায় আহত মানুষের একজন। ২০০৪ সালে নীলা ছিলেন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলাবিষয়ক সহসম্পাদিকা। একুশে আগস্টে আহত হয়ে চিকিৎসার জন্য নানা পথ ডিঙিয়ে থিতু হন সুইডেনে। ১০ বছর ধরে সেখানেই আছেন। এখনো শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন শতাধিক স্প্লিন্টার। চোখ বন্ধ করলে এখনো তাঁকে তাড়া করে ফেরে সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি।

সুইডেনে অবস্থানরত নীলা চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয় টেলিফোনে। অন্য রাজনৈতিক সহকর্মীদের সবার চেয়ে নিজেকে কিছুটা ভাগ্যবান মনে করেন নীলা। কারণ তিনি বিশ্বের উন্নত একটি দেশের চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন। কষ্ট অন্যদের তুলনায় কম। এ জন্য তাঁর কৃতজ্ঞতা শেখ হাসিনার প্রতি। শেখ হাসিনার উদ্যোগেই তিনি বিদেশে যেতে পেরেছিলেন। এর আগে নিজের সহায়-সম্পদ সবই চিকিৎসার পেছনে শেষ হয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেন, এখনো শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। সে কারণে ওষুধ খাচ্ছেন। নিয়মিত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। থেরাপিও নেন। উন্নত চিকিৎসাসেবার সুফল পাচ্ছেন বলে শারীরিক জটিলতা আগের চেয়ে কমে এসেছে।

২০০৪ সালের ২১ আগস্টের হামলা সম্পর্কে নীলা চৌধুরী বলেন, চোখ বন্ধ করলেই পুরো ঘটনাই ভেসে ওঠে। জানতে চাইলে সেই স্মৃতির ঝাঁপিই খুলে বসলেন। জানালেন, ঘটনার দিন অনুষ্ঠান শুরুর বেশ আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে। ট্রাক দিয়ে তৈরি মঞ্চে ওঠার সিঁড়ির দুপাশে অনেকের সঙ্গে তিনিও দাঁড়িয়ে ছিলেন। নীলার উল্টোদিকে ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি বাহাউদ্দিন নাছিম।

নীলা বললেন, ‘নেত্রী আসার সময় হয়ে যাওয়ায় সাড়ে চারটার দিকে সেখানে হালকা ধাক্কাধাক্কি শুরু হয় লাইনে দাঁড়ানোর জন্য। আমি একেবারে ট্রাকের গা ঘেঁষে দাঁড়ালাম। এর মধ্যে নেতারা হালকা রসিকতা করছিলেন। তখনকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ আইসক্রিম খাচ্ছিলেন। মতিয়া চৌধুরী কয়েকজনকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন আমড়ার খোঁজে। আমি মজা করে বললাম, আপনারা তো মজাতেই আছেন, আর আমরা গরমে সিদ্ধ হচ্ছি। এটা শুনে সুরঞ্জিতদা (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত) একটা পানির বোতল ছুড়ে দিলেন। আমি সেটা ধরতে পারলাম না। এর মধ্যে কে যেন দুষ্টুমি করে আমাদের সহকর্মী সাভারের মাহবুবার শাড়ির আঁচল পাশের আরেকজনের আঁচলে গিঁট বেঁধে দিয়েছে। আমি সেটা খুলে দিলাম। ওই সময়ই চারদিকে আওয়াজ, নেত্রী এসে গেছেন। এমন সময় আইভি আপা (আইভি রহমান) আমাদের পাশ দিয়ে সামনে গেলেন।’

স্মৃতির আয়নায় নীলার কাছে সবকিছুই যেন পরিষ্কারভাবে এসে যাচ্ছে। বললেন, ‘নেত্রী বক্তৃতা শেষ করলেন। জয় বাংলা বলে জয় বঙ্গবন্ধু বলারও সুযোগ পেলেন না। প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। আমার পায়ে প্রচণ্ড জ্বলুনি অনুভব করলাম। প্রচণ্ড শব্দে কানে তালা লেগে গেছে। ট্রাকের ডালাটা হাতে ধরা আছে। দেখলাম, দুহাতে কান ঢেকে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা। আমি চিৎকার করে বলার চেষ্টা করছিলাম, নেত্রীকে বাঁচাও। মনে হচ্ছিল, একদল লোক নেত্রীকে ঘিরে ট্রাক থেকে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমার মধ্যে একটা ধারণা এসেছিল, ওই লোকগুলি নেত্রীকে হত্যা করতে নিয়ে যাচ্ছে। ওই সময় আরও কয়েকটি বিস্ফোরণ ঘটে এবং সামনে আহত-নিহত অনেকে পড়ে আছেন।’

নীলা বলছিলেন আর আবেগাপ্লুত হচ্ছিলেন, ‘আমি দেখলাম আমাদের পার্টি অফিসের সামনের ড্রেনটা যেন রক্তের স্রোতে ভরা। আমি তখনো ট্রাকের ডালা ধরে দাঁড়িয়ে। ছোট দুই ছেলের কথা মনে হতে বাঁচার আকুতি জেগে উঠল। ডান পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে সাড়া পাচ্ছিলাম না। দেখলাম, হাঁটুর কাছ থেকে শাড়ি রক্তে ভেজা। হাঁটার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে মাটিতে বসে পড়লাম। দেখলাম কিছুটা দূরেই পড়ে আছে একটি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড। আশঙ্কায় চোখ বন্ধ করে ফেললাম। মনে হচ্ছিল যেকোনো সময় ওটা ফাটতে পারে। তারপরও কনুইয়ে ভর দিয়ে ক্রল করে সামনে এগোতে চেষ্টা করলাম। দেখলাম নিথর হয়ে ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে আছেন মাহবুবা। একটু দূরে আইভি আপা নীরব-নিস্তেজ। আরেকটু এগোতে একটা সাইকেলের পাশে নীরব নিস্তেজ অবস্থায় দেখলাম আমাদের সবার প্রিয় ‘আদা চাচাকে’। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। বাটার দোকানের সামনে কলাপসিবল গেট ধরে দাঁড়ালাম। দেখলাম পেট্রল পাম্পের সামনে একজন গুলি ছুড়ছে। আর পুলিশ নীরব দর্শক। আমার মনে আছে, শুধু বাঁচাও বলে একটি চিৎকার দিতে পেরেছিলাম।’

একুশে আগস্টের বর্বর হামলায় আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় নীলা চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
একুশে আগস্টের বর্বর হামলায় আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় নীলা চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

নীলা জানালেন, ‘জ্ঞান যখন ফেরে তখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাসপাতালের বিছানায়। মাথার পাশে মা বসে আছেন। পরে জেনেছি, আমাকে প্রথম ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়। পরে আনা হয় শমরিতা হাসপাতালে। পাঁচ দিনের মাথায় জ্ঞান ফেরে। এর মধ্যে জেনে গেলাম নেত্রী বেঁচে আছেন। পরিবারের সদস্যরা অস্থির হয়ে পড়েন চিকিৎসকদের একটি সিদ্ধান্তে। স্প্লিন্টারের আঘাতে জর্জরিত দুটি পা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকেরা। তবে সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবদুল জলিল অনেকটা জোর করে ওই সিদ্ধান্ত রদ করান চিকিৎসকদের।’

এর পরে নীলাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে পাঠানো হয়। শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেখানে কয়েক মাস চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরেন। দেশে ফিরে ট্রমা সেন্টারে চিকিৎসা নেন। এভাবে দু বছর পেরিয়ে যায়। দুই পায়ের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাঁর অবস্থা কোনোভাবেই ভালো হচ্ছিল না। শেখ হাসিনার উদ্যোগে তাঁকে তখন পাঠানো হয় প্যারিসের নিউরো হাসপাতালে। সেখান থেকে চিকিৎসার জন্য চলে যান সুইডেনে। সেখানেই থিতু হয়েছেন। সুইডেনের সরকারি খরচে তাঁর চিকিৎসা চলে। এখনো নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন। নীলা জানালেন, প্রায় ১০ বছরে সুইডেনে তাঁর সঙ্গী হয়েছেন স্বামী ও সন্তানেরা। সেখানেই থাকছেন তাঁরা।

নীলার তথ্যমতে, শুধু চিকিৎসাসেবার জন্য সুইডেনে তাঁর স্থায়ী আবাস। নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়, থেরাপি নিতে হয়। তারপরও যখনই সুযোগ পান, দেশে চলে আসেন। দেশের অবস্থা, রাজনীতি সবকিছুই তাঁকে টানে। সুইডেনেও রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। সুইডেন আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা তিনি।

নীলা জানালেন, বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম কলঙ্কিত ঘটনার কুশীলবদের বিচার দেখা তাঁর ইচ্ছে। ইতিমধ্যে মামলায় সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন তিনি। এখন অপেক্ষায় আছেন বিচারের রায় দেখার। এর পাশাপাশি জঙ্গি, মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী চক্রের অবসান চান নীলা। আর আবারও দেশে ফিরে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হতে চান। তবে তিনি বলেন, মাঝেমধ্যে সুইডেনে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে হবে।